আঙুলের ডগায় ভালোবাসা!

ভালোবাসার গল্প June 2, 2016 4,470
আঙুলের ডগায় ভালোবাসা!

টোকিওতে ব্রেইল ক্লাস কোর্সের আজ শেষ দিন। পুরো ক্লাসে একমাত্র আমিই ছিলাম, যে দেখতে পারে। সু শি, জাপানি মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ব্রেইল শিখছ কেন?’


ছয় মাস আগের কথা। জাপানে স্কলারশিপটা হবে হবে অবস্থা। দেশে শেষ কয়েকটা দিন একটু ঘুরতে ইচ্ছে করল।


অনেক দিন হয়ে গেল চট্টগ্রামে মামার বাসায় যাওয়া হয় না। সেখানেই পরিচয় হয় সুমির সঙ্গে। মামার বাসায় ভাড়া থাকে ওরা। ওর বাবা ইঞ্জিনিয়ার। ফুলের মতো মেয়েটা দেখতে পায় না! ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রতিদিন কথা হতো ওর সঙ্গে।


ছোটবেলায় কী একটা দুর্ঘটনার পর চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ওর খুব ইচ্ছে করে ফুল দেখতে, ভোরের শিউলি ফুল। বৃষ্টির পরে রংধনু। ঘুরতে ইচ্ছে করে খুব। ফেসবুক, স্কাইপি—এসব জগৎ সুমির অজানা।


সুমির জগৎটাকে আমি ভালোবেসে ফেলি। ও যখন একা একা আঙুলের ছোঁয়ায় বই পড়ে, আমারও জানতে ইচ্ছে হয় কী পড়ে। এটাকে নাকি ব্রেইল বলে। আঙুলের ডগায় বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জানিয়ে দেয় অদ্ভুত সুন্দর এক ভাষার জগৎ। চট্টগ্রাম থেকে যেদিন আসব, সেদিনই বুঝতে পারি আমি সুমির প্রেমে পড়েছি।


এক জটিল দ্বিধায় আমি আটকা পড়ি। সুমি কি আমাকে ভুল বুঝবে? সিনেমার অন্ধ নায়িকার মতো করুণা ভাববে? ও অন্য কাউকে ভালোবাসে, নাকি বাসে না? আমাকে যদি ফিরিয়ে দেয়?


একসময় আমি চলে আসি টোকিওতে। ভর্তি হই ব্রেইল ক্লাসে। প্রথম যে তিনটা শব্দ টাইপ করতে আর পড়তে শিখি, তার শেষটা হলো ‘ভালোবাসি’। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা জয় করে ফেলেছি। এখন সুমির কাছে গিয়ে টাইপ করা কাগজটা দিয়ে বলব, ‘সুমি, এটা তোমার জন্য।’ কিন্তু শুধু তিনটা শব্দ দিয়ে একটা জীবন কি কাটানো যায়? যায় না।


সু শি, আজ আমি ব্রেইল শিখেছি একটা ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। আমার চোখ দিয়ে একটা আলোহীন জীবন আলোয় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য।


দেশে এসে প্রথমেই চলে যাই চট্টগ্রামে। সোজা সুমিদের ফ্ল্যাটের ঘণ্টা বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে একটা ব্রেইল টাইপ করা চিঠি। তুলে দেব সুমির হাতে। আঙুলের ডগায় বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা পড়ে সুমি কী করবে, সেই চিন্তায় আমি বুঁদ হয়ে থাকি।


‘কাকে চাই?’


একি! সুমি তাকিয়ে আছে আমার দিকে, অথচ চিনতে পারছে না। পরিচয় দেওয়ার পর চিনতে পারে।


‘ও, স্যরি ভাইয়া। আমার গত মাসে চোখের অপারেশন হয়ে গেছে। আমি এখন দেখতে পারি। আপনাকে তো আগে দেখতে পেতাম না, তাই চিনতে পারিনি।’


আমার হয়তো খুব খুশি হওয়ার কথা। আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা। আমার সুমি এখন দেখতে পায়। কিন্তু টাইপ করা চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি এক অবাক অনিশ্চয়তার সাগরে ডুবে যেতে থাকি।


আমার আঙুলের ডগাগুলো অবশ হতে থাকে।