কী কারণে বজ্রপাতে এতো প্রাণহানি ?

জানা অজানা May 14, 2016 1,511
কী কারণে বজ্রপাতে এতো প্রাণহানি ?

কেউ বলেন যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই বজ্রপাতের সূত্রপাত।


বজ্রপাত বেড়ে যাবার কারণ কী এ নিয়ে বাংলাদেশে বিস্তারিত গবেষণা নেই। তবে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষক এর নানা কারণ তুলে ধরেন। কোন কোন গবেষক বলেন, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাত প্রবণ তার মধ্যে দক্ষিণ-এশিয়া অন্যতম।


আবার কেউ বলেন তাৎক্ষণিক পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকা এমন হতাহতের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। অবশ্য কালবৈশাখীর এমন সময়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো ও বজ্রপাত সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বলেও মনে করেন অনেক আবহাওয়াবিদ।


এসবের মধ্যেই বজ্রপাতে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৭৪ জন লোকের প্রাণহানি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে যাচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থা অধিদপ্তর।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাৎক্ষণিক পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকা এমন হতাহতের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। অাবার কালবৈশাখীর এমন সময়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো ও বজ্রপাত সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বলেই মনে করেন আবহাওয়াবিদরা। যদিও বজ্রপাতে এত অল্প সময়ে এতো অধিক লোকের প্রাণহানি এর আগে কখনও দেখা যায়নি বলেও জানিয়েছেন তারা।


বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার জানান, এপ্রিল-মে মাসে আবহাওয়া সাধারণত গরম থাকে। এমন সময়ে বজ্রপাত তৈরি হওয়ার অনুকূল পরিবেশও তৈরি হয়।বিশেষ করে উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কালবৈশাখীর আভাস পেলেই ঘণ্টাখানেকের জন্য আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এই আবহাওয়াবিদ জানান, বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সাধারণ সাইক্লোন-বন্যা এগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু বজ্রপাত মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে।


সবকিছু বিবেচনায় করে ২০১২ সালে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।বজ্রপাতের পরিস্থিতি হওয়ার আভাস পেলেই ধারাবাহিক তাৎক্ষণিক পূর্বাভাস (নাউ কাস্টিং সিস্টেম) দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যে এলাকায় কালবৈশাখীর সৃষ্টি হবে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় বিদ্যুৎ চমকানো ও বজ্রপাতের আশঙ্কার কথা আধ ঘণ্টা পর পর প্রচার করা; যাতে কোন এলাকা দিয়ে তা যেতে পারে তুলে ধরা হবে পূর্বাভাসে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য এ ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হলে এবং জনসচেতনতা তৈরি করা গেলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেত বলে মত দেন সমরেন্দ্র কর্মকার।


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ জানান, স্বল্প সময়ে এবার এতো মানুষের প্রাণহানিতে তারা উদ্বিগ্ন। কেন এভাবে বজ্রপাত হচ্ছে, এতো মানুষের প্রাণ গেল এবং তা কমাতে কী করণীয়-সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে অর্ধশতাধিক লোকের প্রাণহানিতে এটা দুর্যোগ বলা যায়। এর আগে কয়েক ঘণ্টায় এতো লোকের প্রাণহানির খবর নেই। ইতোমধ্যে হতাহতদের সাহায্য করার স্থানীয় জেলা প্রশাসনও এগিয়ে আসবে। ভবিষ্যতে কী করা যায় তাও আমরা ভাবছি।


অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, কালবৈশাখী ঝড়ের এ সময়ে বজ্রপাত হবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে সচেনতা তৈরি করতে হবে। কীভাবে আরো সচেতনতা তৈরি করা যায় তা নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।


সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করব। পাশাপাশি আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কী পদ্ধতি রয়েছে তা নিয়েও মতামত নেব। জেলা প্রশাসন স্বউদ্যোগে হতাহত ব্যক্তির তালিকা করে তাদের সহায়তা করবে বলে জানান রিয়াজ আহমেদ।


বজ্রপাতে বৃহস্পতিবার ৪১ জনের মৃত্যুর পর শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থানে একইভাবে আরও ২৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।


এরমধ্যে রাজবাড়ীতে নিহত হয়েছেন তিন জন। দুই জন করে নিহত হয়েছেন চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নড়াইল, সাভার-ধামরাই, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে।এছাড়া চাঁদপুর, মাগুরা, যশোর ও গাজীপুরে এক জন করে মোট চার জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও স্থানীয় চেয়ারম্যান।


বিলুপ্ত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) সাবেক পরিচালক সুজিত কুমার দেবশর্মা বলেন, কালবৈশাখীর মৌসুমে বজ্রঝড় বেশি হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে দুই থেকে তিনশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।যখন কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হয়, তখনই বজ্রঝড় হয়ে থাকে।


কিউমুলোনিম্বাস মেঘ হচ্ছে খাড়াভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশাল আকৃতির পরিচালন মেঘ; যা থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকানো নয়, বজ্রপাত-ভারি বর্ষণ-শিলাবৃষ্টি-দমকা-ঝড়ো হাওয়া এমনকি টর্নেডোও সৃষ্টি হতে পারে। বায়ুমণ্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-ভাগের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। এ অবস্থায় বেশ গরম আবহাওয়া দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম আবহাওয়া দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়ায় প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়।


বিলুপ্ত এসএমআরসি’র সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা মোহন কুমার দাস বলেন, প্রতি বছর বজ্রপাতে ২-৩ শ’ লোকের প্রাণহানি ঘটে। উপার্জনক্ষম লোকটির মৃত্যুতে পরিবারের অবস্থাও খারাপ হয়ে উঠে। এ অবস্থায় সরকারের সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। পাশাপাশি জনমালের ক্ষয়-ক্ষতি এড়াতে উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ জানান, নিহত ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকা ও আহত ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে।এ সহায়তা বাড়ানোর সুযোগ না থাকলেও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সব থেকে অগ্রাধিকার সচেতনতা তৈরি। এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে।