গরীবের বেঁচে থাকাই আনন্দের

জীবনের গল্প May 7, 2016 1,891
গরীবের বেঁচে থাকাই আনন্দের

আর কিছুদিন পরই আমার কনভকেশন। ছাত্রজীবনের শেষপ্রান্তে বিশেষ একটা দিন। সবার ভেতরেই একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব কাজ করছে। এই আনন্দ ছটা যে আমাকেও র্স্পশ করেনি তা নয়। কিন্তু যতটা স্পনটেনিয়াসলি এই এক্সাইটমেন্টটা উৎযাপন করার কথা ছিল তা আমরা পারছি না। আমরা বলতে আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই।


আমার রেজাল্ট পাবলিশ হয় প্রায় দেড় মাস আগে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় সিভি ড্রপ করেছি। ইন্টারভিউ কলও এসেছে দুটো। কিন্তু ছাত্রজীবনে ক্যারিয়ার নিয়ে দেখা রঙ্গিন স্বপ্নগুলোর প্রতিকৃতি এখন বাস্তব জীবনে ধীরে ধীরে সাদাকালো অবয়বে ফুটে উঠছে। অপরচুনিটি আছে- অফারও আসছে। কিন্তু কোনটাই এট্রাক্টিভ কিছু নয়। এমনকি একটা বেশ নামী কোম্পানী থেকে মাত্র দশ হাজার টাকার অফার আসলো, তাও স্টার্টিং করতে হবে চিটাগং থেকে।


সার্টিফিকেটটা হাতে পাইনি বলে হয়তো ‘বেকার’ শব্দটা আমার নামের সামনে এখনো স্থায়ীত্ব পায়নি। তাই হয়তোবা এমন অফারগুলো অবলীলায় ইগনোর করছি। কিন্তু দিনগুলি যা এমনি করেই কাটবে না তা বেশ বুঝতে পারছি।


স্কুলজীবনে তুখোড় ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসা এই আমি কলেজ লাইফে একটু টালমাটাল হয়ে পড়লেও ভেঙ্গে পড়িনি কখনও। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ভার্সিটি লাইফটাও পার করেছি আড্ডাবাজী আর সিরিয়াসনেসের আশ্চর্য মিশেলে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা আমার চোখে কখনও বিদেশী ডিগ্রীর স্বপ্নের রঙ লাগেনি। কিন্তু বি.এস.সি. এর শেষে আই.বি.এ’র এম.বি.এ. টা কম্পলিট করার ইচ্ছাটুকু এখনো মরে যায়নি। হয়তোবা খুব চেষ্টায় সেখানে চান্সটা পেয়েও যাতে পারি। কিন্তু এক জীবন তরীর তো আর দুটো লক্ষ্য হতে পারে না।


আমার এখন পরবর্তী ডিগ্রীর প্রিপারেশন শুরু করা মানেই হচ্ছে বাবার উপর পুরো পরিবারটার ডিপেন্ডেন্সি আরো তিন বছর এক্সটেন্ড করা। সেক্ষেত্রে আমি পুরো ফ্যামিলি সাপোট পাব। কিন্তু হায়ার স্ট্যটাসের দিকে একধাপ এগিয়ে যেতে হলে সংসারের বড ছেলে হয়ে কর্তব্যবোধের সিড়ি ধরে একধাপ নিচে নেমে আসতে হবে। তাই আমি একেবারে অন্যরকম একটা সময় পার করছি। পিওর সায়েন্সের ছাত্র হয়েও জীবনের এই কম্পলেক্স সিচুয়েশন সলভ করার ইকুয়েশনটা আমার অজানা।


তারপরও আমি মনে হয় অন্য অনেকের থেকে একটু ভাল অবস্থানে আছি। আমার এক বন্ধুর তো বাবা মারা গেছে অনেকদিন আগে। ও’ই সংসারের বড় ছেলে। ও’র আবার দুটো বোন আছে। আরেকজন তো তার মন দিয়ে বসে আছে তার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র এক আপুকে। ও’ই আপুকে এখন বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আর অন্যদিকে ওই বন্ধুটির পক্ষে ও’র বোনের বিয়ের আগে নিজের কোন সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব নয়।

হঠাৎ তৈরী হওয়া এই নতুন পরিস্থিতি কি আমার চারপাশের জগতটা অন্য রকম করে দিল নাকি আমার দৃষ্টিটাই বদলে গেল তা এখনও বুঝতে পারছি না। প্রতিদিনের আড্ডাবাজীর জায়গাটা এখন আর ওরকম ভাবে টানে না। রাস্তার পাশে মামার দোকানে হল্লা করে চা-সিংগারা’র স্বাদ আর আগের মত পাই না। হৃদয়ের কোলাহলগুলো যেন ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে নির্জনতার পর্দায়।


স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার ভয়ে এখন আর স্বপ্ন দেখি না। ভাবাবেগের রঙ ফুরিয়ে গেছে তাই ক্যানভাসে আর নতুন আঁচড় পড়ে না।


তাই বিধাতার প্রতি অনুযোগ, হে বিধাতা, তুমি কেন আমাদের এমন অবস্থায় ফেল? কেন এমন সুন্দর একটা পরিবারে বড় কর? কেন এমন স্নেহময়ী পিতা-মাতা দাও যারা সব দুঃখ কষ্ট সয়ে সন্তানকে আগলে রাখে মমতার চাদরে। কেন এমন একটা আদুরে ছোট ভাই দাও? কেন এমন একটা ফুটফুটে ছোট বোন দাও? অথচ দাও না এদের প্রতিদান দেবার ক্ষমতা। তাইতো অক্ষম বড় ভাইকে দেখতে হয় রিকশা ভাড়ার অভাবে ছোট ভাইয়ের হাটতে হাটতে কোচিংযে যাওয়া। এখনো কাজের শেষে বাবা বাড়ি ফিরে দেখে তার বেকার বড় ছেলেকে। ফুটফুটে বোনটার বোনটার জন্য আসা যোগ্যতম পাত্রগুলো’র প্রস্তাব যখন মা অবলীলায় ফিরিয়ে দেয়-সেই দায়টাকেও মনে হয় সংসারের বেকার বড় ছেলের।


তবুও বিধাতাকে ধন্যবাদ, এত কিছু দেখার পরও তো বাঁচিয়ে রেখেছ। কষ্টের তীরগুলো হৃদয় রক্তাক্ত করে ফেলার পরও তো বেদনায় নীল হয়ে এখনো বেঁচে আছি।


হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি। বেঁচে আছে আমার মত আরো অনেকে।

গরীবের বেঁচে থাকাটাই যে বড় আনন্দের, বড় সুখের।