অশরীরী কন্ঠ

ভূতের গল্প April 24, 2016 2,114
অশরীরী কন্ঠ

ঐতিহাসিক পটভুমিঃ

আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে একটি কাঁচা সড়ক সরাসরি যুক্ত ছিল শরীয়তপুর থানার সাথে। সড়কটা ছিল ৩টি গ্রামের কৃষকদের কৃষি জমির মাঝ বরাবর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কোন এক সময় পাকিস্তানী সৈনিকদের একটি ছোট বাহিনী সেই রাস্তা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আমাদের গ্রামের সাথে রাস্তাটির সংযোগ সড়কের একটা অংশ কাটা থাকায় তারা গ্রামে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হয়। তারা সড়ক বরাবর থানার দিকে এগিয়ে যায় এবং স্বল্প সময়েও তাদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যায়। মৃতের সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না। কারন পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা শেষে লাশগুলো রাস্তার পাশে একটা গভীর কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে যায়। কুয়োটা ছিল একটা হিজল গাছের পাশে। সেই হিজল গাছের আশেপাশের ২/৩ মাইল শুধুই কৃষি জমি। কোন বাড়ি ঘর নেই। সেই কুয়োর কোন নিশানা আজ পাওয়া না গেলেও হিজল গাছটা ঠিকই সাক্ষী হয়ে আছে সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের। এই হিজল গাছ আর কুয়ো নিয়ে অনেক গল্প চালু রয়েছে গ্রামে। রাতের বেলা অনেকেই নাকি এই গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় ”পানি, পানি” বলে আর্তনাদ করতে শুনেছে। আজও নাকি হিজল গাছের পাশদিয়ে আসার সময় মানুষ পথ হাড়িয়ে ফেলে। হিজল গাছ থেকে গ্রামের দুরত্ব আধা মাইলের মত।


শরীয়তপুর থেকে রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময় আশরীর কণ্ঠ শুনেছে এমন অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় গ্রামে। এমনকি রাতের বেলা গ্রামে ফিরতে গিয়ে আধা মাইল পথ সারা রাতেও পার হতে পারে নি, এমন মানুষও কম নেই গ্রামে।


আমাদের আড্ডাঃ-

আমাদের ব্যাচের সবাই জড়ো হয়েছি সিনিয়র এক ভাইয়ের বাসায়। পরের দিন একটা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বন্টনের উদ্দেশ্যে। অল্প কিছু কাজ, অনেক মানুষ। তাই খুব দ্রুত যার যার কাজ ঠিক করে দেয়া হল। এরপর শুরু হল আড্ডা। রাতের আড্ডায় সচারচর যা ঘটে থাকে। কথায় কথায় শুরু হল প্রেতাত্বা, আশরীর কিম্বা ভুতের গল্প। একপর্যায়ে সোহেল ভাই (যে ভাইয়ের বাসায় সবাই ছিলাম) তার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। আমি তার মুখ থেকে যেভাবে শুনেছিলাম সেভাবেই লিখছি।


মুল গল্পঃ-

আমি তখন একটা এনজিওতে চাকরি করি। চাকরি করি না বলে বেগার খাটি বলাই ভাল। কারন কষ্ট যে পরিমান করতে হত বেতন তার ধারে কাছেও ছিল না। কিন্তু অন্য কোথাও চাকরি পাচ্ছিলাম না বলে আমি কষ্টটাই করে যাচ্ছিলাম। সকালে বের হতাম ঋণের টাকা তুলতে, ফিরতাম রাত করে। সম্বল ছিল আমার সাইকেলটা। যে দিনের কথা বলছি সেদিন থানা অফিসে গিয়েছিলাম। সব হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। রাত করে এর আগেও ফিরেছি। তাই কোন কিছু না ভেবে রওনা হয়ে গেলাম। সাইকেল চালাচ্ছি আপন মনে। কোন দিকে খেয়াল নাই। ডেওভোগ (কৃষি জমির মধ্যে ঢোকার আগে শেষ গ্রাম) পার হতেই দেখি কোন মানুষের সাড়া শব্দ নেই। বেশ রাত হয়ে গেছে। গ্রামের কারো জেগে থাকার কথা না। একহাতে টর্চ জালিয়ে রাখতে হচ্ছে বলে সাইকেলের গতি অনেক কম ছিল। হিজল গাছটার কাছাকাছি এসে হটাৎ করে কি যেন হল। কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার সাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে ফেললাম। হাত থেকে টর্চটাও পড়ে গেল। সাইকেল থেকে নেমে টর্চ উঠালাম। ঠিকই আছে। নষ্ট হয় নাই। আবার সাইকেলে চড়ে দ্রুত প্যাডেল চালালাম। আশ্চর্য কান্ড। আমি যত জোড়েই প্যাডেল চালাতে থাকি, সাইকেল মেটেও এগুতে চায় না। ভয়ে আমি শেষ। শরীরের সবটুক শক্তি দিয়ে প্যাডেল মারছি। কিন্তু সাইকেল এগুচ্ছে পিপড়ার গতিতে। আমি ঘেমে একাকার। কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ একজন পিছন থেকে সাইকেল টেনে ধরে আছে। কিন্তু পিছনে তাকানোর মত সাহস আমার নাই। প্রাণপনে সামনে এগুতে চাইছি। হাতে একটা টর্চ আছে সেটাও ভুলে গেছি। আবছা আলোয় রাস্তার যেটুক দেখা যাচ্ছে সেটুক দেখেই রাস্তা ধরে আগাচ্ছি। এক সময় মনে হল জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলব। সাইকেল চালাচ্ছি তো চালাচ্ছি। কতক্ষণ হয়েছে বলতে পারব না। এক সময় মনে হল আমি মনে হয় খালি খালি সাইকেল চালাচ্ছি। কোন লাভ হচ্ছে না। যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি কারন এইটুক রাস্তা সাইকেল যত ধীরেই যাক, পার হতে এত সময় লাগার কথা না। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল হিজল গাছ আর কুয়ো নিয়ে শোনা গল্পগুলো। জোড় করেও মন থেকে দুর করে দিতে পারতেছি না। সাইকেল কেউ টেনে ধরে আছে এই বিশ্বাস তখন আমার মনে একেবারে জেঁকে বসেছে। এইবার বাঁচা মরার প্রশ্ন। ভুতের হাতে কি প্রাণ দেব নাকি? সাহস করে পিছনে তাকালাম। না- কেউ নেই। কেউ টেনে ধরে নাই আমার সাইকেল। টর্চ জ্বালিয়ে পিছনের চাকা পরীক্ষা করলাম। না, কিছুই হয় নাই। আবার সাইকেলে চড়লাম। 'বিসমিল্লাহ্' বলে প্যাডেল চালালাম। কোন লাভ হল না। সাইকেল সেই আগের মতই ভারী। কিছুতেই এগোতে চায় না। এভাবে কতক্ষন সাইকেলের সাথে যুদ্ধ করলাম বলতে পারব না। তবে প্রাণপন চেষ্টাকরে যাচ্ছি গ্রামের দিকে এগিয়ে যাবার। একটু একটু করে এগিয়েও যাচ্ছি। গ্রামের সীমানায় প্রথম বাড়িটা দেখা মাত্র সাহস আরো বেড়ে গেল। শরীরের যেটুক শক্তি অবশিষ্ট ছিল তার সবটুক প্রয়োগ করে দ্রুত সেই বাড়ির উঠানে এসে থামলাম। তারপর কোন কথা না বলে সাইকেল থেকে নেমে শরীরের সবটুক শক্তি দিয়ে মারলাম সাইকেলের পিছনের চাকায় লাথি। শব্দ শুনে বাড়ির মালিক বের হলেন। আমি পরিচয় দিয়ে জানালাম ভয় পাইছি। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। এইবার আমি মহা আশ্চর্য হলাম কারন আমার সাইকেল ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর ভারী মনে হচ্ছে না। ঠিক তুফান গতিতে চলছে।


সোহেল ভাই এই পর্যন্ত বলে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন, “এবার তোমার ব্যাখ্যা কও। কেন সেদিন এমন হইছিল?”