বিস্ময়কর ৭ গ্রহ

বিজ্ঞান জগৎ July 2, 2017 1,287
বিস্ময়কর ৭ গ্রহ

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন, যার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কিছু নক্ষত্রের চেয়েও বেশি!


বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই সৌরজগতের বাইরে থাকা গ্রহগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন এবং একের পর এক গ্রহ অবিষ্কার করে চলেছেন। এর মধ্যে থেকে বিস্ময়কর কিছু গ্রহ নিয়ে এ প্রতিবেদন।


সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ

একটি গ্রহ তার কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের কাছাকাছি থাকায় কতটা উত্তপ্ত হতে পারে এবং সেই নক্ষত্রটিই বা কতটা উত্তপ্ত।


আমাদের সৌরজগতের মধ্যে, সূর্যের সবচেয়ে নিকটতম গ্রহটি হচ্ছে বুধ। সূর্য থেকে যার দূরত্ব ৫৭,৯১০,০০০ কিলোমিটার। সৌরজগতের প্রথম এবং ক্ষুদ্রতম এই গ্রহের তাপমাত্রা ৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অন্যদিকে সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।


কিন্তু সূর্যের চেয়েও বেশি শক্তিশালী নক্ষত্র রয়েছে।


সম্প্রতি আবিষ্কৃত কেল্ট-৯ নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি বড় এবং নক্ষত্রটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।


বুধ গ্রহ সূর্যের যতটা কাছে অবস্থিত তার চেয়ে বেশি কাছে অবস্থিত এই নক্ষত্রটির ‘কেল্ট-৯ বি’ নামক গ্রহটি। তাদের মধ্যেকার সঠিক দূরত্ব বিজ্ঞানীরা পরিমাপ করতে না পারলেও জানিয়েছেন, কেল্ট-৯বি গ্রহটি এর নক্ষত্রের খুব কাছে অবস্থান করছে এবং এর পুরো কক্ষপথ একবার ঘুরে আসতে মাত্র ১.৫ দিন সময় নেয় (সূর্যকে বুধ একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৮৮ দিন)।


আর এর ফলাফল হচ্ছে, ‘কেল্ট-৯ বি’ গ্রহটি সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্রহের তাপমাত্রা ৪৩২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস! পাথুরে গ্রহ বুধ এ তাপমাত্রায় গলিত লাভার একটা পিন্ডের মতোই মনে হবে।


যা হোক, ‘কেল্ট ৯ বি’ গ্রহটি বৃহস্পতি গ্রহের মতোই গ্যাসীয় গ্রহ। তবে বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বড় হলেও এর ঘনত্ব অনেক কম। এর কারণ হল অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে বেলুনের ন্যায় ফাপা হয়ে গেছে। উত্তাপের কারণেই গ্রহটিতে পানি, কার্বন ডাই অক্সাইড এগুলো গঠিত হতে পারে না। এর বায়ুমণ্ডলে কোনো অনুর অস্তিত্ব থাকাও সম্ভব নয়।


সবচেয়ে শীতলতম গ্রহ

‘ওজিএলই-২০০৫-বিএলজি-৩৯০এলবি’ গ্রহটি সবচেয়ে শীতলতম গ্রহ। পৃথিবীর ভরের তুলনায় সাড়ে ৫ গুণ বেশি ভরের এই গ্রহটি পাথুরে গ্রহও হতে পারে।


পৃথিবী থেকে ৩,৩০০ আলোকবর্ষ দূরে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। যদিও গ্রহটি এর হোস্ট নক্ষত্র (যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে) থেকে অনেক বেশি দূরে নয়, তবে এর হোস্ট নক্ষত্রটি কম ভর ও লাল বামন অর্থাৎ শীতল নক্ষত্র।


স্টার ওয়ার্স ফ্রাঞ্চাইজের সিনেমায় বরফ গ্রহ হিসেবে জনপ্রিয় এ গ্রহটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাস্তব সিনেমাটির বিপরীত, প্রাণের অস্তিত্বের উপযোগী নয় গ্রহটি। কারণ গ্রহটির বেশিরভাগ গ্যাসই হিমায়িত এবং গ্রহটির পৃষ্ঠ তুষারাবৃত।


সবচেয়ে বড় গ্রহ

যদি একটি গ্রহ একটি নক্ষত্রের মতো উত্তপ্ত হতে পারে, তাহলে গ্রহ এবং নক্ষত্রের মধ্যে পার্থক্যটা কী থাকল?


গ্রহের তুলনায় অনেক গুণ বেশি বড় হয়ে থাকে নক্ষত্র এবং নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো ও তাপ সৃষ্টি করে থাকে। উদাহারণস্বরুপ আমাদের পরিচিত নক্ষত্র সূর্যে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির মধ্য মাধ্যমে সূর্যের জ্বলন প্রক্রিয়া চলে।


কিন্তু বাদামী বামন শ্রেণীর এক ধরনের নক্ষত্র রয়েছে। এই ধরনের নক্ষত্রগুলো ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় হলেও, বজায় রাখার মতো যথেষ্ট বড় না। হাইড্রোজেন ফিউশন শুরু হবার আগেই পৌঁছে যায় স্থিতিশীল অবস্থায়।


‘ডেনিস-পি জে০৮২৩০৩.১-৪৯১২০১ বি’ নামক গ্রহটির ভর বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় ২৮.৫ গুণ বেশি। তাই এই গ্রহটিকে নাসার আবিষ্কৃত সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভারী গ্রহ হিসেবে পরিচিত।


তবে এতো বেশি ভরের কারণে এই গ্রহ হয়ে পড়েছে বিতর্কিত। এটাকে আদৌ গ্রহ (বৃহস্পতির মতো গ্যাসীয় গ্রহ) বলা যাবে কিনা নাকি বাদামি বামন নক্ষত্র বলা হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আরো অদ্ভূত বিষয় হচ্ছে, এর হোস্ট নক্ষত্র নিজেই একটি বামন নক্ষত্র।


সবচেয়ে ছোট গ্রহ

আমাদের চাঁদের তুলনায় সামান্য বড় এবং বুধ গ্রহের চেয়ে ছোট ‘কেপলার-২৭ বি’ হলো সৌরজগতের বাইরে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে ছোট আকৃতির গ্রহ।


সূর্যের সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ বুধ। সূর্য আর বুধের যে দূরত্ব তার চেয়ে কম দূরত্ব রয়েছে পাথুরে গ্রহ ‘কেপলার-২৭ বি’ এবং এর নক্ষত্রের মধ্যে। তার মানে গ্রহটির তরল পানীয় থাকার মতো উত্তপ্ত এবং প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা বিদ্যমান।


সবচেয়ে বেশি বয়সি গ্রহ

‘পিএসআর বি ১৬২০-২৬ বি’ গ্রহটি ১২,৭০০ কোটি বছর বয়সি, যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীনতম গ্রহ। মহাবিশ্ব ১৩,৮০০ কোটি বছরের পুরোনো অর্থাৎ গ্রহটির তুলনায় মাত্র ১,১০০ কোটি বছর পুরোনো।


সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি ছাড়া সৌরজগতের বাকি সবগুলো গ্রহের ভরকে একত্র করলেও বৃহস্পতির ভর আড়াই গুণ বেশি হবে। আর ‘পিএসআর বি ১৬২০-২৬ বি’ গ্রহটির ভর বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। এটি পৃথিবী থেকে ১২,৪০০ আলোকবর্ষ দূরে স্কর্পিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত।


গ্যাসীয় দৈত্যাকার এই গ্রহটির দুটি হোস্ট নক্ষত্র একে অপরের চারপাশে ঘূর্ণায়মান। এর মধ্যে একটি নিউট্রন নক্ষত্র এবং অন্যটি বামন নক্ষত্র। যা হোক, গ্রহটি যেহেতু মহাবিশ্বের ইতিহাসে খুব শিগগির গঠিত হয়েছে, তাই গ্রহটিতে সম্ভবত প্রাণের বিবর্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত ভারী উপাদান যেমন কার্বন এবং অক্সিজেন (পরে গঠিত) নাই।


সবচেয়ে কম বয়সি গ্রহ

‘ভি৮৩০ তৌরি বি’ নামক গ্রহটি মাত্র ২ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। যে নক্ষত্রটির চারপাশে গ্রহটি ঘুরছে তার ভর আমাদের সূর্যের ভরের মতোই কিন্তু ব্যাসার্ধে দ্বিগুণ, তার মানে গ্রহটি চূড়ান্ত আকৃতিতে সম্পূর্ণভাবে এখনো সংকুচিত হয়নি।


পৃথিবী থেকে ৪২৭ আলোকবর্ষ দূরে টরাস নক্ষত্রপুঞ্জে এর অবস্থান। গ্যাসীয় দৈত্যাকার এই গ্রহটি বৃহস্পতি গ্রহের তিন চতুর্থাংশ ভরের সমান এবং সম্ভবত গ্রহটি এখনো বেড়ে চলেছে। অর্থাৎ গ্রহটি তার পথের মধ্যে অন্যান্য কিছু যেমন গ্রহাণুর সঙ্গে ঘন ঘন ধাক্কা লাগার মাধ্যম আরো বেশি ভর অর্জন করছে। ফলে গ্রহটি খুবই অনিরাপদ একটি স্থান হিসেবেই ধারণা করা হয়েছে।


সবচেয়ে বাজে আবহাওয়ার গ্রহ

সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো যেহেতু আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত এবং গ্রহগুলোর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করা সহজ ব্যাপার নয়, তাই সবচেয়ে বাজে আবহাওয়ার গ্রহ হিসেবে আমাদের সৌরজগতের মধ্যেকার গ্রহের দিকেই চোখ রাখা যাক।


যদি আপনি জুনো মহাকাশযান দ্বারা তোলা বৃহস্পতি গ্রহের ঘূর্ণিঝড়ের ছবিটি দেখেন, তাহলে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় এই গ্রহটি অবশ্যই বাজে আবহাওয়ার গ্রহের জন্য অবশ্যই উপযুক্ত একটি প্রতিদ্বন্দ্বী।


তবে সবচেয়ে বাজে আবহাওয়ার গ্রহের খেতাব বিজয়ী আসলে শুক্র গ্রহ। সূর্য থেকে দ্বিতীয় নিকটবর্তী গ্রহ শুক্রের আকৃতি পৃথিবীর মতোই। গ্রহটির বায়ুমন্ডল পৃথিবীর তুলনায় ১০০ গুণ বেশি ঘন এবং বায়ুমন্ডলের শতকরা ৯৫ ভাগই কার্বন ডাই অক্সাইড। গ্রহটির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৪৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফলে বুধ গ্রহের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত এই গ্রহটি। এছাড়াও পৃথিবীর মতো পানির বাষ্পে ঘনীভূত হওয়া মেঘের বদলে শুক্রে রয়েছে সালফিউরিক এসিড বাষ্পীভূত হওয়া মেঘ।


গ্রহের ঘূর্ণনের চেয়ে বায়ুমন্ডল আরো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে, যার ফলে গরম ঝড়ো বাতাসের গতিবেগ সেখানে ঘণ্টায় ৩৬০ কিলোমিটার। এই বাতাস কঠিন সীসাকে তরলে রূপান্তরিত করার মতো যথেষ্ট গরম।