ইতিকাফের উদ্দেশ্য ও করণীয়-বর্জনীয়

ইসলামিক শিক্ষা June 13, 2017 1,001
ইতিকাফের উদ্দেশ্য ও করণীয়-বর্জনীয়

ইবাদত করা ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে মসজিদে পূর্ণাঙ্গ অবস্থানকে ইতিকাফ বলে। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে ‘মুতাকিফ’ বলে। ইতিকাফ যে কোনো সময় করা যায়। যখনই কেউ ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবস্থান করেন তখনই তা ইতিকাফ বলে পরিগণিত হয়। তবে রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাত।


ইতিকাফের গুরুত্ব: আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য ইতিকাফ একটি উত্তম পন্থা।


দুনিয়ায় মানুষকে হাজারো ব্যস্ততা ও ঝামেলার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। শয়তান মানুষের পিছে অবিরাম লেগে আছে। প্রতিটি কাজে সে মানুষকে ধোকা দেবার চেষ্টা করে। সে মানুষের পাপাত্মাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগ্রত করে তোলে। তাই দুনিয়ার প্রতিটি কাজেই মানুষকে অবিরাম পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এ পরীক্ষায় কখনো কখনো মানুষের পদঙ্খলন হয়ে যায়।


স্ত্রী-সন্তানাদির মায়া, তাদের সুখের চিন্তা, দারিদ্র্যের অনুভূতি, লোভ, মোহ, আকর্ষণ মানুষকে প্রতিনিয়ত গুনাহের দিকে টানতে চায়। অথচ পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও পরহেযগারীর জীবনই আল্লাহ তা’য়ালার পছন্দনীয়। কেবল পবিত্র আত্মার লোকেরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। কেবল আল্লাহর ধ্যান ও তার চিন্তাই মানুষকে আল্লাহর নিকটে পৌঁছে দেয়। যে ব্যক্তি যতো বেশি পরিচ্ছন্ন ও গভীরভাবে আল্লাহকে উপলদ্ধি করতে পারে, সে ততো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়।


বস্তুত ইতিকাফ মানুষের জীবনে একটি সুযোগ এনে দেয়। সংসার ও সামাজিক যাবতীয় কাজকর্ম ও লেনদেন থেকে কিছু সময় কিছু দিনের জন্য মুক্ত হয়ে মানুষ একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকার সুযোগ পায় ইতিকাফের মাধ্যমে। এখানে স্ত্রীর চিন্তা নেই, স্বামীর চিন্তা নেই, সন্তানাদির চিন্তা নেই, সম্পদের চিন্তা নেই। মোটকথা, সকল চিন্তার ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষ এখানে একমাত্র আল্লাহর চিন্তায় মশগুল হবার সুযোগ পায়।


সে প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহকে ধ্যান করে, তাকে গভীরভাবে অনুভব করে। তার আজাবের কথা মনে করে ভীত-কম্পিত হয়ে ওঠে। তার পুরস্কারের কথা স্মরণ করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তারই পথে চলার জন্য তারই জন্য নিজেকে কুরবানী করার জন্য সে মানসিকভাবে সুদৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ইতিকাফ মানুষের উপর এমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি করে, যা তাকে দীর্ঘদিন আল্লাহর পথে তথা পরহেযগারীর পথে পরিচালিত করে। তাই ইতিকাফের মাধ্যমে মানুষ অনেক পুণ্য ও নেকী অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। ইতিকাফ মুমিন জীবনের পাথেয়।


ইতিকাফের প্রকারভেদ: ইতিকাফ প্রধানত তিন প্রকার। যেমন- ১. ওয়াজিব ইতিকাফ, ২. সুন্নাত ইতিকাফ ও ৩. মুস্তাহাব ইতিকাফ।


ক. ওয়াজিব ইতিকাফ : মান্নতের ইতিকাফ ওয়াজিব। চাই তা শর্তে হোক কিংবা হোক বিনা শর্তে। শর্তে হবার অর্থ হচ্ছে, কারো একথা বলা, আমার অমুক উদ্দেশ্য হাসিল হলে আমি ইতিকাফ করবো। ওয়াজিব ইতিকাফ কমপক্ষে একদিন হতে হবে। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। হাদিসে আছে, হযরত ওমর (রা.) একদিন রাসূলকে (সা.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ জাহেলী যুগে আমি মসজিদে হারামে এক রাত ইতিকাফ করার মান্নত করেছিলাম। হুজুর (সা.) বললেন, তোমার মান্নত পূর্ণ করো। (বুখারী)


খ. সুন্নাত ইতিকাফ : রমজান মাসের শেষ দশদিনের ইতিকাফ হচ্ছে সুন্নত। (কেবলমাত্র হানাফী মাযহাবে রমজানের শেষ দশ দিনের) এ ইতিকাফ হচ্ছে সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তবে কিছু সংখ্যক লোক ইতিকাফ করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হবে বলে এ মাজহাবের রায়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হুযুর (স) সব সময় রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত এ নিয়ম তিনি পালন করেছেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফের সিলসিলা জারি রাখেন। (বুখারী)


গ. মুস্তাহাব ইতিকাফ : রমজানের শেষ দশ দিন ব্যতীত অন্য যে কোন সময় ইতিকাফ করা মুস্তাহাব। মুস্তাহাব ইতিকাফের জন্য কোনো সময় নির্দিষ্ট নেই। এ ইতিকাফ সামান্য সময়ের জন্যও হতে পারে কিংবা এক দিন বা একাধিক দিনের জন্যও হতে পারে।


ইতিকাফের শর্তাবলী:

১. মুসলমান হওয়া।


২. বালেগ ও আকেল হওয়া।


৩. পবিত্র থাকা।


৪. ইতিকাফের নিয়ত করা।


৫. পূর্ণাঙ্গ সময় (আবশ্যকীয় প্রয়োজন ব্যতীত) মসজিদে অবস্থান করা ইত্যাদি।


নারীদের ইতিকাফ: হাদিস থেকে জানা যায, নারীরাও ইতিকাফ করতে পারে। নারীদের ইতিকাফ গৃহকোণে (নামাজের স্থানে) বাঞ্ছনীয়। নারীদের ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। সন্তান প্রসব করলে বা গর্ভপাত হলে কিংবা ঋতুরাব দেখা দিলে ইতিকাফ ছেড়ে দিতে হবে।


ইতিকাফ অবস্থায় করণীয়: ইতিকাফ অবস্থায় আল্লাহর জিকির, তাসবিহ, ইস্তেগফার, দরূদ, কুরআন তিলাওয়াত ও জ্ঞানচর্চা করা মুস্তাহাব। মসজিদে থেকে করা সম্ভব এমন সব ইবাদতই ইতিকাফ অবস্থায় করা যায়।


ইতিকাফ বাতিল হয়ে যায় যেসব কারণে:

১. মসজিদ বা ইতিকাফের স্থান থেকে নিস্প্রয়োজনে বের হলে।


২. ইসলাম পরিত্যাগ করলে। ৩. অজ্ঞান, পাগল বা মাতাল হলে|


৪. মাসিক দেখা দিলে। ৫. সন্তান ভূমিষ্ট হলে বা গর্ভপাত হলে।


৬. সহবাস করলে।


৭. বীর্যপাত ঘটালে।


৮.মুতাকিফকে কেউ জোরপূর্বক মসজিদে থেকে বের করে দিলেও ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।