কোরবানির গরু চোর

হৃদয় স্পর্শকাতর গল্প April 18, 2016 7,450
কোরবানির গরু চোর

- স্যার, কোরবানির গরু চোর ধরেছি!

- গরু চোর?

- হ স্যার, আসেন বিচার কইরা দেন!


অফিস শেষ করে রাত সাড়ে বারোটায় বাসায় ঢুকবো। দেখি গ্যারেজে লোকজন জড়ো হয়ে বসে আসে। একটা ছেলেকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখা মাত্রই বাসার কেয়ার টেকার এগিয়ে এসে আমাকে গরু চোর ধরার ঘটনাটি জানালো। আমি এগিয়ে গেলাম জটলার কাছে। বারো কি তেরো বছরের ছেলে। গায়ে লাল রঙের পলো শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। আমরা যে লাল রঙের গরুটা কুড়িল তিনশো ফিট রাস্তার হাট থেকে কিনেছি কোরবানির জন্য সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হাতে- পায়ে মার খাওয়ার দাগ দেখা যাচ্ছে। ছেলেটির সামনে বসা আমার পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আবদুল খালেকের হাতে লাঠি দেখে বুঝলাম তিনিই ছেলেটিকে পিটিয়েছেন। আমাকে দেখে সবাই এখন শান্ত। কেউ কিছু বলছে না। ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে হাউ মাউ করে কেদে ফেললো।


বললো- বড়ভাই, আমি চোর না! আমি শুদু গরু দেখতে আইছিলাম।


আমি তাকিয়ে আছি ছেলেটির মায়াবি চোখের দিকে। ছেলেটি একবার আমার দিকে তাকায় আরেকবার গ্যারেজের মধ্যে পিলারের সঙ্গে বেঁধে রাখা কোরবানির গরুর দিকে তাকায়। গরুটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবদুল খালেক ভাইকে ছেলেটির বাঁধন খুলে দিতে বললাম। খালেক ভাই কোনো কথা না বাড়িয়ে আমার কথা শুনলেন। ছেলেটির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। আমি কেয়ারটেকারকে বললাম, ঘটনাটি খুলে বলেন তো?


কেয়ারটেকার আমাকে বললেন, আমি যখন এশার নামাজে যাবো তখন দেখি ছেলেটি শুধু বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছে। নামাজ পড়ে এসে পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছি! তখন দেখি ছেলেটি পকেট গেট খুলে ভেতরে যাচ্ছে। আমি দ্রুত গিয়ে দেখি গরুর রশি খুলছে। কেয়ারটেকার যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন ছেলেটি বারবার বলছিলো


- বড়ভাই, আমি চোর না! ভাই আমি চোর না! আমি গরু দেখতে আইছিলাম।


আর জড়ো হওয়া লোকজনেরা বলতে ছিলো- তাইলে গরুর রশি খুলতে গেছিলি ক্যান?


আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে বললাম- তোমার নাম কি?

ছেলেটি মলিন কণ্ঠে বলে- রুবেল। আমি বলি, গরুটি কি তোমাদের ছিলো?


আমার কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটি হাউ মাউ করে কাদতে কাদতে ফ্লোর থেকে উঠে দাড়ায়। চোখ মুছতে মুছতে বলে- জি বড়ভাই! লালাইটা আমাদেরই ছিলো!


এতোক্ষণ গরুটা শুয়ে জাবর কাটতে ছিলো। ছেলেটির মুখে লালাই নামটা শোনার পর হাম্বা বলে উঠে দাড়ায়। ছেলেটিও মমতার টানে গরুটির কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটি গরুটির শরীরে হাত বুলায়; গরু হাম্বা ডাকে! মাথায় হাত বুলায়; গরু হাম্বা ডাকে! গলায় হাত বুলায়; গরু হাম্বা ডাকে। গরুর সঙ্গে ছেলেটির মমতা দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে। তাকিয়ে দেখি এতোক্ষণ যিনি লাঠি দিয়ে ছেলেটিকে পিটিয়েছেন তারও চোখ ভেজা। এতোক্ষণ যারা জড়ো হয়ে বসে ছিলো তারা একে একে গ্যারেজ থেকে বের হয়ে যায়। কেয়ারটেকার গেট বন্ধ করে দেন।


আমি রুবেলকে কাছে ডেকে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলায়ে বলি- তোমাদের বাড়ি তো ধামরাই তাই না?

ও মাথা নেড়ে বলে- হ ভাই।

আমি বলি- তুমি এতদূর এই বাসায় আসলে কেমনে?


ও বলে- আমি গরু বেঁচতে আইসা তো আর বাড়িতেই যাই নাই! আব্বা চইলা গেছে!

বলি- বাড়িতে যাও নাই কেনো?

ও বলে- বড়ভাই, লালাইরে রাইখা বাড়িতে যাইবার মন চাইতেছিলো না!


গেটে কে যেনো নক করছে। কেয়ারটেকার গিয়ে খুলে দেয়। দেখি যার কাছ থেকে গরুটি কিনে আনা হয়েছিলো তিনি এসে হাজির।


রুবেল দৌড়ে গিয়ে বলে- "আব্বা, চলো লালাইরে নিয়া যাই!"