রণ-ভেরী - কাজী নজরুল ইসলাম

যুদ্ধের কবিতা January 20, 2017 4,238
রণ-ভেরী - কাজী নজরুল ইসলাম

[গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা-তুর্ক-গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালাইতেছিলেন, সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ হইতে দশ হাজার স্বেচ্ছা-সৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনিয়া লিখিত]


ওরে আয়!

ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়–

ওরে আয়!

ঐ ইস্‌লাম ডুবে যায়!

যত শয়তান

সারা ময়দান

জুড়ি খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়!

আজ শখ করে জুতি-টক্করে

তোড়ে শহীদের খুলি দুশ্‌মন পায় পায়–

ওরে আয়!

তোর জান যায় যাক, পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়!

ধরে ঝন্‌ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুরু মুস্‌লিম-পঞ্জায়!

তোর মান যায় প্রাণ যায়–

তবে বাজাও বিষাণ, ওড়াও নিশান! বৃথা ভীরু সম্‌ঝায়!

রণ- দুর্মদ রণ চায়!

ওরে আয়!

ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!

ওরে আয়!

ঐ ঝননননন রণ-ঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!

শুনি এই ঝন্‌ঝনা-ব্যঞ্জনা নেবে গঞ্জনা কে রে হায়?

ওরে আয়!

তোর ভাই ম্লান চোখে চায়,

মরি লজ্জায়,

ওরে সব যায়,

তবু কব্‌জায় তোর শম্‌শের নাহি কাঁপে আফ্‌সোসে হায়?

রণ- দুন্দুভি শুনি খুন-খুবি

নাহি নাচে কি রে তোর মরদের ওরে দিলিরের গোর্দায়?


ওরে আয়

মোরা দিলাবার খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায়!

তারা খিঞ্জির যারা জিঞ্জির-গলে ভূমি চুমি মূরছায়!

আরে দূর দূর! যত কুক্কুর

আসি শের-বব্বরে লাথি মারে ছি ছি ছাতি চড়ে! হাতি

ঘা‌'ল হবে ফেরু-ঘায়?

ঐ ঝননননন রণঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!

ওরে আয়!

বোলে দ্রিম্‌ দ্রিম্ তানা দ্রিম, দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!

ঐ শের-নর হাঁকড়ায়–

ওরে আয়!

ছোড়্ মন-দুখ,

হোক কন্দুক

ঐ বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক, স্পন্দুক বুক ঘা'য়!

নাচ্ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ–

থৈ তা‌ণ্ডব, আজ পাণ্ডব সম খাণ্ডব-দাহ চাই!


ওরে আয়!

কর কোর্‌বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই।

ঐ দীন্ দীন্-রব আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায়!

শেল– গর্জন

করি তর্জন

হাঁকে, বর্জন নয় অর্জন আজ, শির তোর চায় মায়!

সব গৌরব যায় যায়;

বোলে দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!

ওরে আয় !

ঐ কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সাজ্জায়!

ওরে আয়!

মুখ ঢাকিবি কি লজ্জায়?


হুর্ হুর্‌রে।

কত দূর রে

সেই পুর রে যথা খুন-খোশ্‌রোজ খেলে হর্‌রোজ দুশ্‌মন-খুনে ভাই!

সেই বীর-দেশে চল্ বীর-বেশে,

আজ মুক্ত দেশে রে মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায়!

ওরে আয়!

বল্‌ 'জয় সত্যম্ পুরুযোত্তম', ভীরু যারা মার খায়!

নারী আমাদেরি শুনি রণ-ভেরী হাসে খলখল হাত-তালি দিয়ে রণে ধায়!

মোরা রণ চাই রণ চাই,

তবে বাজহ দামামা, বাঁধই আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায়!

মোরা সত্য ন্যায়ের সৈনিক, খুন-গৈরিক বাস গা'য়।

ওরে আয়!

ঐ কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সজ্জায়!

ওরে আয়!

অব– রুদ্ধের দ্বারে যুদ্ধের হাঁক নকিব ফুকারি যায়!

তোপ্ দ্রুম্ দ্রুম্ গান গায়!

ওরে আয়!


ঐ ঝননরণন খঞ্জর-ঘাত পঞ্জরে মূরছায়!

হাঁকো হাইদার,

নাই নাই ডর,

ঐ ভাই তোর ঘুর-চর্খীর সম খুন খেয়ে ঘুর্ খায়!

ঝুটা দৈত্যেরে

নাশি সত্যেরে

দিবি জয়-টীকা তোরা, ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায়!


ওরে আয়!

মোরা খুন্‌-জোশি বীর, কঞ্জুশি লেখা আমাদের খুনে নাই!

দিয়ে সত্য ও ন্যায়ে বাদশাহি, মোরা জালিমের খুন খাই!

মোরা দুর্মদ, ভর্‌পুর্ মদ

খাই ইশ্‌কের, ঘাত-শম্‌শের ফের নিই বুক নাঙ্গায়!

লাল পল্টন মোরা সাচ্চা,

মোরা সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,

মরি জালিমের দাঙ্গায়!

মোরা অসি বুকে বরি হাসি মুখে মরি জয় স্বাধীনতা গাই!

ওরে আয়!

ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!!


• শব্দার্থ :


শম্‌শের– তরবারি।

খুন-খুবি– রক্তোন্মত্ততা

দিলির– সাহসী, নির্ভীক

দিলবার– প্রাণবন্তা।

জিঞ্জির– শিকল

শের-বববরে– সিংহ

শের-নর– পুরুষসিংহ

হাঁকাড়ায়– গর্জন করিতেছি

কোরবান– উৎসর্গ

খুন-খোশ-রোজ– রক্ত-মহোৎসব।

হররোজ– প্রতিদিন

আমামা – শিরস্ত্রাণ

নকিব– তূর্যবাদক

হাইদার– মহাবীর হজরত আলীর হাঁক

খুন-জোশ– রক্ত-পাগলামি

কঞ্জুশি– কৃপণতা

ইশকের– প্রেমের

শহীদান– শহীদ