হিন্দু-মুসলমান - জীবনানন্দ দাশ

ধর্মীয় কবিতা December 14, 2016 3,758
হিন্দু-মুসলমান - জীবনানন্দ দাশ

মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে

পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে!

আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,

মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,

জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,

সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;

সন্ন্যাসী আর পীর

মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!


কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?

-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী;

আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা

ওগো ভারতের মোসলেমদল,- তোমাদের বুক-জোড়া!

ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,- আর্যাবর্ত ভাঙি

গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!

-নবীন প্রাণের সাড়া

আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!


রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন,- তোমার প্রাণ!

-হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,- হেথায় তোমার ত্রাণ;

হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা;

যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা,

গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,

চক্ষে তোমার ভারতের আলো,-ভারতের রবি, শশী,

হে ভাই মুসলমান,

তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!


এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,

হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা;

-হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,

ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!

পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।

অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!

-ভারতী কমলাসীনা

কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!


এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল

স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!

-গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,

পরশে তাদের জেগেছে আরব- উপন্যাসের রাতি!

জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি,-লাহোর,-ফতেহপুর,

যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!

নতুন প্রেমের রাগে

তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার আরুণে ‌জাগে!


জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,-কালের নিকষ কোলে

বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে!

সেলিম,-শাজাহাঁ,- চোখের জলেতে এক্‌শা করিয়া তারা

গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা!

-ছড়ায়ে রয়েছে মোঘল ভারত,- কোটি সমাধির স্তূপ

তাকায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন,-অপলক অপরূপ!

-যেন মায়াবীর তুড়ি

স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!


মোতিমহলের অযুত রাত্রি,- লক্ষ দীপের ভাতি

আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!

-আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে

অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!

দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন্‌ গজল-ইলাহী গান!

পথ-হারা কোন্‌ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!

-নিখিল ভারতময়

মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!


এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে,

একদা যাদের শিবিরে- সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,

আজিকে তাহারা পড়শি মোদের,- মোদের বহিন-ভাই;

-আমাদের বুকে বক্ষে তাদের,-আমাদের কোলে ঠাঁই

‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে,- ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,

মোস্‌লেম্‌ বিনা ভারত বিফল,- বিফল হিন্দু বিনা;

-মহামৈত্রীর গান

বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান!