ইসলামের দৃষ্টিতে পুত্রবধূ ও শাশুড়ির সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত!

ইসলামিক শিক্ষা November 23, 2016 1,488
ইসলামের দৃষ্টিতে পুত্রবধূ ও শাশুড়ির সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত!

ইসলামে নৈতিকতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মানুষকে আইনের ঊর্ধ্বে উঠে নৈতিকতার ওপর চলতেই তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু আইনের সম্পর্ক নয়, বরং তাদের সম্পর্ক হৃদয় ও আত্মার সম্পর্ক।


কেবল আইনের বিশুদ্ধ উত্তাপের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে না কোনো সুস্থ সমাজ, বরং কল্যাণ তখনই হবে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যখন আইনের গণ্ডি অতিক্রম করে রাসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের সুন্নতের ওপর চলতে সচেষ্ট হবে। এ জন্যই রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাজে রান্না বান্নার কাজ নারীরাই আঞ্জাম দিতেন। রাসুল (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রী-কন্যারাও ঘরের কাজ তাঁরা নিজেরাই করতেন।


ফাতেমা (রা.) মহিলাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ

আদরের কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-কে স্বামীগৃহে পাঠানোর পর প্রিয় নবী (সা.) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এভাবে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন যে ঘরের ভেতরের কাজ স্ত্রী করবে আর বাইরের কাজ করবে স্বামী। (যাদুল মাআদ : ৫/১৬৯)


হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আটা পিষতে পিষতে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল এবং এ জন্য হজরত আলী (রা.)-এর বড় আফসোস ছিল। তাই একজন সেবিকা পাওয়া যায় কি না সে ব্যাপারে প্রিয়তমা স্ত্রীকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান পিতা সায়্যিদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পাঠিয়েছিলেনও। নববী শিক্ষায় উদ্ভাসিত প্রিয় কন্যা সে লক্ষ্যে পিতার কাছে গেলেও মুখ ফুটে তা ব্যক্ত করতে পারেননি। পরে মহান পিতা জানতে পেরে নিজেই মেয়ে-জামাতার কাছে এসে শিক্ষা দিয়ে গেলেন মহান শিক্ষা।


মহান পিতা রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ফাতেমা! যতক্ষণ পর্যন্ত মদিনার প্রতিটি মানুষ সেবাদাস না পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদের (সা.) কন্যাকে কোনো সেবিকা দেওয়াটা পছন্দ করি না। তোমাকে কি আমি এর চেয়েও উত্তম কিছু দেব? ফাতেমা (রা.) বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, রাতে যখন তোমরা ঘুমোতে যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। তা তোমাদের জন্য সেবিকার চেয়েও উত্তম হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১১৩)


এটাই হলো ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতার ব্যাপার। তবে এটা সম্পূর্ণ স্ত্রীদের ঐচ্ছিক ব্যাপার। এর জন্য কাউকে বাধ্য করার অনুমতি শরিয়ত কাউকে দেয় না। কিন্তু প্রচলিত সমাজ তো বাধ্যই করছে। যদি বাধ্য করা না হতো, বিষয়টাকে সম্পূর্ণ স্ত্রীর এখতিয়ারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো, সেই সঙ্গে পরিবারের সবাই মিলে ইসলামী আদর্শের চর্চা অব্যাহত রাখা হতো, তবে একই রকম সেবা স্ত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া যেত আর তা হতো অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ।


শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা

অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িসহ ননদ-দেবরের সেবাও স্ত্রীর একটি অতিরিক্ত কাজ। এটা তার দায়িত্ব নয়। কিন্তু বর্তমান সমাজ বিষয়টাকে কিভাবে দেখছে? মনে করা হয়, এটা তার অপরিহার্য দায়িত্ব বরং এটিই যেন তার প্রধান দায়িত্ব। ছেলের জন্য বউ আনাই হয় শ্বশুর-শাশুড়ির সেবার জন্য। এ সবই পরিমিতিবোধের চরম লঙ্ঘন। মা-বাবার সেবা করা সন্তানের দায়িত্ব, পুত্রবধূর নয়। (আল-বাহরুর রায়েক ৪/১৯৩, কিফায়াতুল মুফতি ৫/২৩০)


তবে এখানে অবশ্যই স্মরণীয় যে, যদি স্বামীর মা-বাবার খেদমতের প্রয়োজন হয়, তাহলে স্বামীর কর্তব্য হলো তাঁদের সেবা-যত্ন করা। তবে কোনো স্ত্রী যদি সন্তুষ্টচিত্তে স্বামীর মা-বাবার সেবা করেন, এটা তাঁর পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এর বিনিময়ে তিনি অনেক সওয়াব পাবেন। তবে এসব করতে আইনত তিনি বাধ্য নন।


যদিও কাম্য এটাই যে স্বামীর মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান ও সমীহের চোখে দেখবেন। তাঁদের মনেপ্রাণে ভালোবাসবেন এবং তাঁদের সেবা করতে পারাকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করবেন।


অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িও পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আদর ও খাতির করবেন। তার সুখ-সুবিধার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন।


আমাদের সমাজের আবহমান কালের চলমান রীতি হলো, যৌথ পরিবারগুলোতে পুত্রবধূরা শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন করে থাকেন। এটাকে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। গ্রামগঞ্জে দেখা যায়, শ্বশুর-শাশুড়ির সংসার থেকে আলাদা হলেও পুত্রবধূদের তাঁদের দেখাশোনা করতে হয়।


শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করার এ রীতি সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও দেখা যায়। হজরত কাবশা বিনতে কা’ব বিন মালেক (রা.) ছিলেন হজরত আবু কাতাদা (রা.)-এর পুত্রবধূ।


কাবশা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আবু কাতাদা (রা.) [কাবশা (রা.)-এর শ্বশুর] ঘরে প্রবেশ করেন। ঘরে প্রবেশ করে তিনি অজুর পানি খোঁজ করেন। তখন কাবশা (রা.) শ্বশুরকে নিজ হাতে পানি ঢেলে দেন....। (আবু দাউদ, হাদিস : ৭৫)


এর বিপরীতে এটাও স্বীকার করতে হবে যে আমাদের সমাজের রীতি অনুযায়ী পুত্রবধূর কোনো সন্তান জন্ম নিলে দাদা-দাদি বৃদ্ধ বয়সেও নাতি-নাতনির জন্য অনেক শ্রম ব্যয় করেন। আদর-যত্নে তাদের লালনপালন করেন। এটা কিন্তু তাঁদের আইনত দায়িত্ব নয়। তবুও তাঁরা এ ‘দায়িত্ব’ পালন করেন।


আসলে ব্যাপারটির সঙ্গে নৈতিকতা ও মানবতাবোধ জড়িত। এ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের দাবি হলো—স্ত্রীর ওপর যতটুকু হক আছে, স্বামী তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। এর অতিরিক্ত ব্যাপারগুলো তাঁর ওপর চাপানো ঠিক নয়। হ্যাঁ, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করলে ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য নৈতিকতাবোধ দ্বারা চালিত হওয়া।


অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কাছেই পরিষ্কার থাকতে হবে, কার দায়িত্ব কতটুকু এবং তাঁর বেশি নৈতিকতার চাহিদা কী? স্ত্রী তাঁর নৈতিকতার ভিত্তিতে যা করবেন, তা রান্নাবান্না হোক, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা হোক বা অন্য কিছু, তা তিনি যতটুকুই করবেন, তাঁকে স্বতন্ত্র মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নিতে হবে এবং সে জন্য তাঁকে প্রশংসার দাবিদার মনে করতে হবে।


শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের ব্যাপারটা আসলে নতুন কোনো বিষয় নয়। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এই সম্পর্ক চলে এসেছে।


কোরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা বিভিন্ন মানবিক সম্পর্কের সীমা-পরিসীমা, দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে জ্ঞান পাই। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই সম্পর্কের দায়িত্বগুলো কখনো একপক্ষীয় হলে চলে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয়, আমরা কেবল নিজের অধিকার আর পাওনাগুলো নিয়েই ভাবি, কর্তব্য নিয়ে ভাবতে চাই না। আর তখনই সংসারে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।


লেখক : ফতোয়া গবেষক ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।


-কালের কন্ঠ