তিতুমীর এবং বাঁশের কেল্লার ইতিহাস!

জানা অজানা November 16, 2016 2,324
তিতুমীর এবং বাঁশের কেল্লার ইতিহাস!

শহীদ তিতুমীর ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী একজন বিপ্লবী। অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীরের আসল নাম হচ্ছে, সৈয়দ মীর নিসার আলী। তার ডাকনাম তিতুমীর হলেও তার দাদি তাকে তিতা-মীর নামে ডাকতেন। এর পেছনে অবশ্য একটি কারণও ছিল। তিতুমীর ছেলেবেলায় খুব রোগা ছিলেন।


রোগ নিরাময়ের জন্য তার দাদি গাছের বাকল, লতা-পাতা, শিকড় বেটে তিতা রস বানিয়ে তাকে খাওয়াতেন। তিনি অনায়াসে গিলে ফেলতেন সেই তিতা রস। সেই থেকে দাদি তাকে ডাকতে শুরু করেন তিতা-মীর। তিনি ইংরেজি শাসক ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথ বেছে নেন।


বিদ্রোহ ও বাঁশের কেল্লা:

১৮২২ সালে হজ পালন করেন। সে সময় তার চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। মক্কায় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তিতুমীরকে নিয়ে তার পীর হযরত সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর কাছে যান। ধর্ম সংস্কারক ব্রেলভী ছিলেন উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। মদিনার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে মিসর, পারস্য, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থান ও পীর-আলেমদের কবর জিয়ারত শেষে ভারতবর্ষে ফেরেন।


তিতুমীর ১৮২৭ সালে গ্রামে ফিরে শিরক ও বিদাতমুক্ত সমাজ গঠনের দাওয়াতে নেমে পড়েন। অল্প দিনেই তিন-চারশ’ শিষ্য সংগ্রহ করেন দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর শুরু হয় ওয়াহাবীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার।


এমনকি দাড়ি, মসজিদ নির্মাণ, নাম পরিবর্তনের ওপর খাজনা আদায় শুরু হয়। এসব কারণে তিতুমীরের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়। স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে জয়লাভ করেন তারা। তার নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা খাজনা দেয়া বন্ধ করে। এরপর বারাসাতে সরকারের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চব্বিশ পরগণার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন।


বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত এ বিদ্রোহে বর্ণ হিন্দুর অত্যাচারে জর্জরিত অনেক হিন্দু কৃষকও অংশগ্রহণ করে।


এতে গোবর গোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হন। তিতুমীরকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠায়।


কিন্তু আলেকজান্ডার যুদ্ধে পরাস্ত হয়। এরপর বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণের এক যুদ্ধে নদীয়ার কালেক্টর এবং নদীয়া ও গোবর ডাঙ্গার জমিদারের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিতুমীর জয়ী হন। তিতুমীর নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই বছর জমিদার কৃষ্ণ দেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজ পুরে (বর্তমান সর্প রাজপুর) শত শত লোক জড় করে শুক্রবার জুমার নামাজ রত অবস্থায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন দু’জন মৃত্যুবরণ করেন ও অসংখ্য যোদ্ধা আহত হন।


১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর সরফরাজ-পুর থেকে নারকেলবাড়িয়ায় চলে আসেন তিনি। ২৩ অক্টোবর বাঁশ এবং কাদা দিয়ে দুই স্তরবিশিষ্ট বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। বাঁশের কেল্লা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ। এ সময় তার অনুসারী সংখ্যা প্রায় ৫০০০ জন।


২৯ অক্টোবর কৃষ্ণ দেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর এ বিষয়ে মামলা দায়ের করতে গেলে কোনো ফল হয় না। ৬ নভেম্বর কৃষ্ণ দেব আবার নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ করে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে হতাহত হয় প্রচুর। এরপর গোবর ডাঙ্গার আটি নীলকুঠির ম্যানেজার মি. ডেভিস ৪০০ হাবশি যোদ্ধা নিয়ে নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করলেন। শেষ পর্যন্ত মি. ডেভিস প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ২-৩ দিন পর জমিদার দেবনাথ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে সংঘর্ষে প্রাণ হারান।


আরো কয়েকটি সংঘর্ষের পর ১৩ নভেম্বর ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য ও দুটি কামানসহ নারকেলবাড়িয়ায় পাঠান। প্রচণ্ড সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। দারোগা ও একজন জমাদ্দার বন্দি হন।


১৯ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে সেনা বহর পাঠান। স্টুয়ার্ট বিরাট সেনা বহর ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করেন। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার সৈনিক। ছিল না পর্যাপ্ত গোলাবারুদ-বন্দুক।


তবুও প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। কিন্তু তারা তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়াতে পারেননি। গোলার আঘাতে ছারখার হয়ে যায় কেল্লা। শহীদ হন বীর তিতুমীরসহ অসংখ্য মুক্তিকামী সৈনিক। ২৫০ জনেরও বেশি সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দি করে।


পরে এদের কারো কারাদণ্ড আবার কারো ফাঁসি হয়। এভাবেই বাঁশের কেল্লা আন্দোলনের মহানায়ক তিতুমীর ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজিদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় শহীদ হন এবং ধ্বংস হয় তার ইতিহাস বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা।


শহীদ তিতুমীরের মৃত্যুতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন আরো একশ’ বছর পিছিয়ে যায়। কিন্তু এতে দমে যায়নি বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষা বরং এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের বাসনা আরো তীব্রতর হয়।


এনআই