ধ্বংসাত্মক কয়েকটি কবিরা গোনাহ, যে গুলো আমাদের ঈমানকে নষ্ট করে দেয়

ইসলামিক শিক্ষা October 29, 2016 1,230
ধ্বংসাত্মক কয়েকটি কবিরা গোনাহ, যে গুলো আমাদের ঈমানকে নষ্ট করে দেয়

ইসলাম ডেস্ক: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে কেউ কোনো মুআহিদকে (যাকে মুসলমানরা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব হতেও পাওয়া যায়। (বোখারি/মেশকাত : ৩৩০৪)।


গোনাহ দুই প্রকার। ক. কবিরা। খ. সগিরা। আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূল (সা.) যেসব গোনাহের ব্যাপারে কোনো শাস্তি আরোপ করেছেন এবং স্পষ্টভাবে তা থেকে বারণ করেছেন তাই হলো কবিরা গোনাহ। তবে কবিরার মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন স্তর। কোনো কোনো কবিরা গোনাহ আল্লাহ তায়ালার সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার কোনোটা বান্দার সঙ্গে সম্পর্কিত। নিম্নে গুরুতর কয়েকটি কবিরা গোনাহ নিয়ে আলোচনা করা হলো :


ক. শিরক করা

কবিরা গোনাহের স্তরে এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং স্পর্শকাতর। মহান আল্লাহ তায়ালার সত্তা, গুণাবলি ও কার্যাবলিতে অন্য কাউকে শরিক করা বা সমকক্ষ জ্ঞান করাই শিরক। যেমন- আল্লাহর কাছে মোনাজাত করার মতো জীবিত বা মৃত কারও নিকট প্রার্থনা করা। কবর বা মাজারে সেজদা করা, কোনো ব্যক্তিসমষ্টি বা সংগঠককে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিশ্বাস করা, পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তায়ালাকে ছেড়ে এমন কাউকে ডাকবে না যে তোমার কোনো উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। তারপরও যদি তুমি এরূপ কর তাহলে তুমি জালেমদের মধ্যে গণ্য হবে। (সূরা ইউনুস : ১০৬)।


অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। (সূরা মায়িদা : ৩১২)।


শিরক ঈমানকে ধ্বংস করে দেয় এবং শিরককারী ব্যক্তি কাফের বলে গণ্য হয়। এমনকি শিরকই একমাত্র গোনাহ, যা ছাড়া আল্লাহ সব গোনাহকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ কখনও তার সঙ্গে শরিক করার গোনাহ ক্ষমা করবেন না। এছাড়া আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।


খ. শিরকের পর মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে গর্হিত ও মন্দ কাজ হলো অন্যায়বিহীন মানুষের প্রাণনাশ করা। চাই তা ভ্রুণ হোক কিংবা অন্য কেউ। মানবহত্যা মানবতা বিধ্বংসী ও সুস্থ বিবেকবর্জিত অপরাধ। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, কোনো মোমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চেয়ে দুনিয়াটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহর কাছে অধিকতর সহজ। (তিরমিজি)।


এমনকি একজন মানুষের প্রাণনাশ করা সব মানবজাতির প্রাণনাশের নামান্তর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা



করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। (সূরা মায়িদা : ৩২)।


অন্যায়ভাবে হত্যাকারীর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির হুশিয়ারি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে তার শাস্তি হলো জাহান্নাম। যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। (সূরা নিসা : ৯৩)।


হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে কেউ কোনো মুআহিদকে (যাকে মুসলমানরা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব হতেও পাওয়া যায়। (বোখারি/মেশকাত : ৩৩০৪)।


এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিরাপত্তা প্রদত্ত কাফেরের জানমালও মুসলমানের ন্যায় সংরক্ষিত। তাদের ওপর আঘাত হানাও জঘন্যতম অপরাধ।


উপরোক্ত বিধানগুলো হত্যাকারীর পাশাপাশি হত্যায় সহায়তা দানকারীর ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামান্য কথার দ্বারাও কোনো মোমিনের হত্যার ব্যাপারে সহায়তা করল সে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার কপালে লেখা থাকবে ‘আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ।’ (ইবনে মাজাহ/মেশকাত : ৩৩৩১)।


গ. সুদ খাওয়া

সুদ বলা হয় বিনিময়বিহীন অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে। ইসলাম এবং ইসলামী শরীয়ত শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও মনষ্যত্বহীনতার পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত। সম্পদের ব্যবহার ও ভোগের ক্ষেত্রে ইসলাম দিয়েছে ব্যাপক অধিকার। কিন্তু যে ভোগের কারণে সমাজের অন্যজন নির্যাতিত হয় এবং শিকার হয় দুঃখ-কষ্টের সেই ভোগকে ইসলাম হারাম করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমের বর্ণনা, আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা : ২৭৫)।


ব্যবসা-বাণিজ্য যেহেতু মানবিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম, তাই ইসলামী শরীয়ত তা গ্রহণ করেছে। আর সুদ যেহেতু মানবতা বিরোধী শোষণমূলক লেনদেন, তাই ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে।


ইসলাম সুদকে শুধু হারামের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সুদের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে যে ধমকি এসেছে অন্য কোনো পাপের বেলায় এমনটা করা হয়নি। এরশাদ করা হয়েছে, হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা যদি প্রকৃত মোমিন হয়ে থাক তবে সুদের যে

অংশই অবশিষ্ট রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও, আর যদি তোমরা সুদকে পরিত্যাগ না কর তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। (সূরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।


রাসূল (সা.) বর্ণনা করেন, সুদের গোনাহের ৭০টি স্তর রয়েছে। এর সর্বনিম্নটি হলো স্বীয় মাতাকে বিবাহ করা। (মেশকাত : ২৭০২)।


সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন কঠিন হুশিয়ারি বাণী আসার পরেও যে এর থেকে নিবৃত হবে না তার মতো হতভাগা কে হতে পারে। এমন কেউ কী আছে যে তার মোকাবেলায় রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হবে।


ঘ. আহলে এলমকে অবজ্ঞা করা

আহলে এলম বলা হয় যারা কোরআন ও হাদিসের বুৎপত্তি অর্জন করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে। কোরআন-হাদিস যেমন সম্মানিত এর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ব্যক্তি এবং বস্তুও তেমন সম্মানিত। এক প্রস্থ কাপড় দিয়ে যখন কোনো জামা তৈরি করা হয় এর সম্মান এবং মূল্য যতটুকু হয়, পবিত্র কোরআনুল কারিমের সামান্য গিলাফটির মূল্য তার চেয়ে শতগুণ বেশি হয়। আর এটাই ঈমানের দাবি।


আল্লাহ তায়ালা আহলে এলম সম্পর্কে কোরআন পাকে বর্ণনা করেন, হে নবী আপনি বলুন! যারা প্রাজ্ঞ আর যারা অপ্রাজ্ঞ তারা কী সমান হতে পারে? (জুমার : ৯)।


হজরত মোয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের বিজ্ঞ আলেম বানিয়ে দেন। (বোখারি ও মুসলিম, মেশকাত : ১৮৯)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়, একজন এবাদত গুজার ব্যক্তির ওপর একজন আহলে এলমের মর্যাদা তেমন পূর্ণিমা রাতে সব নক্ষত্রের ওপর চাঁদের মর্যাদা যেমন, আর আহলে এলমরাই হলো আম্বিয়া কেরামদের উত্তরসূরি। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত : ২০০)।


১৪০০ বছর আগে মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তার অবর্তমানে কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধি হিসেবে আহলে এলমদের নির্বাচিত করা হয়। কেয়ামত পর্যন্ত তারা রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই নির্বাচিত থাকবে।

কেউ যদি অন্তর থেকে আহলে এলমকে অবজ্ঞা এবং ঘৃণা করে তার ঈমান থাকবে না। কারণ আহলে এলমকে অবজ্ঞা করা প্রকারান্তরে রাসূল (সা.) কেই অবজ্ঞা করা হলো। আর রাসূল (সা.) কে অবজ্ঞা এবং কটাক্ষকারী কখনও মুসলিম থাকতে পারে না।


তাই সচেতন সব মুসলমানকে ভেবে দেখা উচিত, আহলে এলমের মর্যাদা নিজের ভেতর কতটুকু বিদ্যমান? আমি আহলে এলমকে কটাক্ষ করে রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্তদের অবজ্ঞা করে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করতে পারব কি? সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ এবং রাসূলের অবাধ্য হয়ে পরকালে কীভাবে মুক্তির আশা করতে পারি?-হাবীবুল্লাহ আল মাহমুদ