বিদেশের কোনো স্থান নয়, এটি সিলেটের 'লোভাছড়া'

দেখা হয় নাই September 18, 2016 1,492
বিদেশের কোনো স্থান নয়, এটি সিলেটের 'লোভাছড়া'

নীলাকাশে সাদা বকের উড়াউড়ি। ঢেউয়ের দোলায় ছন্দময় দুলুনি। চোখ জুড়ানো সবুজের আস্ফালন। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা বিশুদ্ধ হাওয়া।


সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নে অবস্থিত এক মনোহরিনী স্থান লোভাছড়া। মূলত 'লোভাছড়া চা বাগান'ই নাম এটির। আর এই চা বাগানের সূত্র ধরেই পুরো গোটা একটা বিশাল এলাকার নাম হয়েছে লোভাছড়া।


দেখলে মনে হবে বিদেশের কোনো স্থানেই ভ্রমণে বেরিয়েছেন। কিন্তু না, বাস্তবিক পক্ষেই আশ্চর্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের 'লোভাছড়া'। যেখানে মিশে আছে পাহাড়, মেঘ আর আকাশ! নদীর স্রোতে ইঞ্জিনহীন ডিঙ্গি নৌকার ভেসে চলা কিংবা পাথর নিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা বিশালাকারের স্টিমার, সেইসাথে স্টিমারকে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলা শ্রমিকদের জীবনচিত্র- সবকিছু দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথই থাকে না! বড় বড় স্টিমারের ছুটে চলার পথ বেয়ে নদীজলের আস্ফালন, বিশাল সব ঢেউ বুকে অদ্ভূত শিহরণ বইয়ে দেয়।


সিলেট থেকে বাসে বা সিএনজিতে কানাইঘাট পৌঁছে সেখান থেকে সুরমা নদীর বুক চিরে নৌকাযোগে যেতে হয় লোভাছড়ায়। আর নৌকায় ওঠার পর থেকেই শুরু হয় নাগরিক কোলাহলমুক্ত, বিষের বাতাসমুক্ত ও যান্ত্রিকতার দাবানল ছাড়া স্নিগ্ধ-সুশোভিত এক নতুন পথচলা।


নৌকা চলার কয়েক মিনিট পরেই যে কেউ হারিয়ে যাবে নিজসত্ত্বা থেকে। ইঞ্জিন নৌকার বটবট শব্দ, নৌকার ঝাঁকুনি, ঢেউয়ার দোলায় অবাক ছন্দে উপর-নিচ দোল খাওয়া, সীমাহীন আকাশের ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টানো রং, ঝাকঝাক সাদা বকের দলের হাওয়ার সাথে উড়াউড়ি- এসবকিছুই যে কাউকে নিজের অজান্তেই টেনে নিয়ে যাবে ভাবনার উন্নাসিক এক জগতে।


নদীপাড়ের মানুষের জীবনচিত্র দেখতে দেখতে আপনি কখন পৌঁছে যাবেন কাঙ্খিত লোভাছড়ায়, সেটা টেরই পাবেন না। ভাবছেন, এতো চমৎকার সব দৃশ্য অবলোকনের পর লোভাছড়ার আর কিইবা দেখবো? দেখার অনেককিছুই আছে!


লোভাছড়ার যেখানে গিয়ে আপনার নৌকা থামবে, সে জায়গাতেই নদীর পাথুরে পাড় দেখে আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন নিশ্চয়ই। আর পাশেই চারিদিকে বিশালাকারের ডালপালা নিয়ে স্বগর্বে দন্ডায়মান বটবৃক্ষকে ঘিরে চা শ্রমিকদের চা পাতা নিয়ে কাজকারবার দেখতে আপনি থমকে যাবেন অবশ্যম্ভাবীভাবে। এরপর দু’তিন মিনিট হাঁটলেই হারিয়ে যাবেন সবুজ নিসর্গের মাঝে।


হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়বে লোভাছড়ার বাসিন্দাদের অদ্ভূত নির্মাণশৈলীর ছোট ছোট কুটি। কুটির থেকেই চেয়ে থাকা ছোট্ট শিশু-কিশোরদের মায়াবী চাহনি দেখে আপনার মনে হবে এমন চাহনি কতোদিন যে দেখিনি!


চারপাশের মনমাতানো সবুজের শ্যামলীমায় মুগ্ধ হয়ে আপনি হাঁটছেন ক্লান্তিহীনভাবে। হঠাৎ করেই থমকে যাবেন, এ কি! রাঙ্গামাটিতে চলে এলাম নাকি! আপনার এই বিস্ময়ের কারণ রাঙ্গামাটির মতোই একটি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে এই লোভাছড়ায়! আপনি আরো বিস্মিত হবেন, যখন দেখবেন ব্রিজটির গায়ে খোদাই করে লেখা রয়েছে- ‘ব্রিজটি নির্মিত হয় ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে!’


৩ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ঝুলন্ত ব্রিজ আপনাকে ঘোরের মধ্যে ফেলবে যে, সেই আমলে এই বনভূমিতে ৩ টন ধারণক্ষমতার কোন যানবাহন চলতো?! কারা বসবাস করতো এখানে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাকে ইতিহাসের আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।


আপনি হাঁটছেন আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে আধার দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। আপনার মুগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দেবে বড্ড বিশাল এক হাতিকে মাহুত নিয়ে যাচ্ছে দেখে। সারি সারি চা গাছ, মুকুলসহ চায়ের পাতা, ঘন নিবিড় বন থেকে ভেসে আসা পাখ-পাখলির গুঞ্জন আপনাকে বিমোহিত করবে।


পথের এক জায়গায় পেয়ে যাবেন শত বছরের পুরনো বিরাটাকারের এক বট বৃক্ষ। এমন বৃক্ষ আপনি আর কোনোদিনও দেখেননি, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়! চারপাশে শতাধিক ডালপালা নিয়ে স্বদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষটি যেন নিজেকে এই লোভাছড়া চা বাগানের কর্ণধার ঘোষণা করছে! গুচ্ছমূলের বটবৃক্ষটির গুড়ায় রয়েছে নানান রঙ্গের ফুলের আবাস। আর বটবৃক্ষের গায়ে মানুষের পাঁজরের হাঁড়ের মতো অবিকল দৃশ্য দেখে আপনি বিস্ময়াভিভূত হবেন! বৃক্ষটির প্রাচীন গা জুড়ে জন্ম নিয়েছে অমূল্য সব অর্কিড। আর এই বটবৃক্ষটিকেই নিজের প্রিয় আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী।


যেভাবে যাবেন:

দেশের যেকোনে জায়গা থেকেই সিলেট এসে বাসে করে ৬০ টাকা দিয়ে যাওয়া যাবে কানাইঘাট। অথবা সিলেট থেকে সিএনজি রিজার্ভ করেও যাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ভাড়া নেবে ৬শ টাকার মতো। কানাইঘাট থেকে নৌকা করে লোভাছড়ায় যেতে জনপ্রতি ভাড়া নেবে ৩০-৪০ টাকা করে। চাইলে রিজার্ভ নৌকাও নিতে পারেন।


যা সঙ্গে নেবেন:

ক্যামেরা, দুপুরের খাবার, পানি, হালকা নাশতা, লুঙ্গি বা থ্রি কোয়ার্টার।


সাবধানতা:

দল বেঁধে চলবেন, নয়তো পথ হারিয়ে ফেলতে পারেন। নদীতে জলকেলি খেলার সময় গভীরে যাবেন না। সাঁতার না জানলে নদীতে নামবেন না। নদী তীরে কোথাও ডুবোচর আছে কিনা, স্থানীয় মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিবেন। লোভাছড়ায় ঢুকার সময় জুতো পায়ে রাখবেন। সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করবেন না।