আবছা নীলের মায়া

ভালোবাসার গল্প September 15, 2016 3,793
আবছা নীলের মায়া

১.

বরই গাছটার পাতার ফাকে ফাকে রোদের নিষ্প্রাণ লুকোচুরি |

দেখতে বড় ভাল লাগে শুভ্রার,কি চমৎকার আলোছায়ার খেলা | হঠাৎ হঠাৎ রোদের ঝলকানি যখন মুখে এসে পড়ে তখন কেমন যেন লাগে |

মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙতেই একটু বিরক্তি এলো,চুপচাপ থাকার সময় কোন কথা বলতে ভাল্লাগেনা আসোলে |


- এই শুভ্রা,কিরে এখানে যে?

- তাহলে কোথায় থাকব?

- ফাইজকে একটু দেখতে যা,কাল ঈদ আর আজ দুজন দুমুখি | আরে সংসারে এরকম কত ঝগড়াঝাটি হয়,যা মামণি |

- আমি ওর পাশে থাকলে ওর ঈদ মাটি হবে |

- আহহা মামণি...ওহহো বলতেই ভুলে গেছি,আজ একদম সকালে ওর বড়বোন ফোন করেছিল |

- তাই ! কি বলল?

- ফাইজের ডানহাতের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছিল,তাই এখন পুরাহাত ব্যান্ডেজ | ইস বেচারা ছেলেটার কি হল |

- আম্মু আমার উঠতে ভাল্লাগছেনা,ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিবে? গোছানোই আছে,টুকিটাকি একটু ভরে দাও |

- দিচ্ছি,মনটা ফ্রেশ কর |

- করছি...


মা বিছানায় লাল ব্যাগটা রেখে গোছগাছে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন | শুভ্রার দৃষ্টি ঐ হালকা মেঘঢাকা আকাশে,বৃষ্টি হবে নাকি?

ফাইজের গম্ভীর চেহারাটা বারবার চোখটাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে |

কি দরকার এত ঝাপসা হওয়ার,কি আছে ঐ চেহারায় রাগ আর নিষ্ঠুরতা ছাড়া?

কিন্তু ঐ চেহারাকেই যে খুব ভালবেসে ফেলেছে,একদম মন থেকে |


ফার্মগেটের বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এখন শুভ্রা দাড়িয়ে |

নাকের কাছে একফোটা ঘাম গড়ানোর অপেক্ষায় | আশপাশের পরিবেশটা কেমন অন্যরকম | সবার চোখেমুখে একধরনের চাপা উত্তেজনা,চাপা আনন্দ |

কাল ঈদ,আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কাল পরিবারের সবার সাথে ঈদ করবে,একসাথে ঈদগাহে যাবে,ছোটদের নিয়ে যাবে মেলায় | মেলায় কত খেলনা !

একটা বাস এসে থামল,অমনি হুড়াহুড়ি | বাবারে যাত্রিদের বাসে ওঠার যুদ্ধ দেখলেই গলা শুকিয়ে যায় |

ভালমত নেমপ্লেট দেখল শুভ্রা |

নাহ এটা ওর বাস নয় | মিরপুরের বাস তো এতো দেরি করেনা,ইস এই রোদে আর কতক্ষন দাড়াতে ভাল্লাগে? এখানের আকাশটা একদম পরিস্কার |

এতটুকু দাড়াতেই মাথাটা কেমন ঝিম দিয়ে গেছে,তৃষ্ঞা পাচ্ছে যে খুব | মোবাইলে রিং হচ্ছে,প্রথমবার না শুনলেও এবার শুনেছে ও |

ব্যাগের মধ্যে এতকিছুরে বাবা,টাকাপয়সা এত অগোছালো কেন?

কোনরকম ফোনটা বের করে দ্রুত রিসিভ করল,হ্যালো...


- শুভ্রা প্লীজ আসো

ফাইজের কন্ঠস্বর শুনে চোখের পাতা কেমন কেপে উঠল,ছেলেটার কন্ঠ এরকম হল কিভাবে?একদম ভেঙে গেছে,চেনাই যাচ্ছেনা |


- এই শুভ্রা

- হুম আমি আসছি | ফার্মগেটে বাসের জন্য দাড়াইয়া আছি |

- আমি তো তোমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিছি,এতক্ষনে বোধহয় পৌছে গেছে |

- ও...

- যাও তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দেও,আমি ড্রাইভারকে থাকার জন্য বলে দিতেছি কেমন |

- আচ্ছা...তোমার গলা..না কিছুনা |

- কি,বল...

- না,আসতেছি আমি |


ফোনটা ব্যাগে রেখে কাউন্টারের দিকে এগোয়,টিকিটটা ফেরত দিতে হবে | যাক বাসে ওঠার টেনশন শেষ |

শুভ্রার চোখে পানি টলটল করছে,উফ বিরক্তিকর ! পানিটা একটু তড় সইতে পারেনা?


২.

ঝরঝর বৃষ্টির শব্দ আগেথেকেই ভাল লাগে ফাইজের |

এখন একটু বেশি ভাল লাগছে,তবে হঠাৎ করে বুকে একটা ভয় দাপিয়ে যায় প্রবলভাবে | খুব ভয় লাগে ওর,কান্না আসে প্রচন্ড কিন্তু...

কিন্তু পারেনা কাদতে,লজ্জা হয় | আপা এসে কাদতে দেখলেই সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমত ঝেড়ে যাবে | অথচ শুভ্রা কত ভাল,খালি আদর করে |

মেয়েটা কি খুব রাগ করে আছে?


রুমে ঢুকে ফাইমা একটু চমকে গেল,দারুণ খুশি শুভ্রাকে দেখে |


- এত তাড়াতাড়ি এসে পড়েছিস আপু !

- জ্যাম আজ তেমন পড়েনি বলা যায় এদিকটাতে,আমাদের ঐ লাইনে আবার ভীষন জ্যাম |

- হুম | তা ফ্রেশ না বসে আছিস কেন,যা বাথরুমে যা |

- আপা,ওকি ঘুমায়?

- না,বৃষ্টি দেখে | কিছুক্ষন আগে দেখে আসলাম গুনগুন করে গান গাচ্ছে | তুই আসবি,মনে খুশি ধরেনা |

ফাইমার হাসি থামতেই শুভ্রা ওর হাত ধরে বলে,আপা ওর কাছে গিয়ে কি বলব আমি?

- কিছুই বলার দরকার নেই,মাথাটা জড়িয়ে আদর করে দিস |

- আচ্ছা...

- ওকে এতদিন খুব বকাঝকা করেছি,থাপ্পড়ও দিয়েছি কয়েকটা | এতবছর আমাকে জ্বালিয়েছে,এখন আবার তোকে | আরো যদি মারতাম !

- আহা এতবড় ছেলেটাকে মারলে,ও খুব কেদেছে না?

- যা ইচ্ছা করুক,আমি কি করব !

- আচ্ছা থাক,আমি এসেছি তুমি আর মাথা গরম করনা তো |

- যা রুমে যা এখন |


ব্যাগটা নিয়ে ওরুমে পা বাড়াল শুভ্রা,চোখের পাতা এখন অসহ্যরকম কাপছে | আর পানিতো জমে আছে সেই কখনথেকেই |

শুভ্রার হাতের স্পর্শে চোখ মেলল ফাইজ | হালকা হালকা ঘ্রাণ আসতেই বুঝেছে শুভ্রা এসেছে বোধহয় | শুভ্রার ঘ্রাণ যে ওর মুখস্থ |

ঠোটের কোণে একটু হাসি ফুটিয়ে ফাইজ বলল,তোমাকে মারার শাস্তি দেখেছ শুভ্রা? এইযে দেখ,খুব ভাল হয়েছেনা?


ঝরঝর কেদে দিল শুভ্রা |

আস্তে ফাইজের মাথাটা জাপটে ধরে খুব কাদছে | কান্নাজলে ভিজছে ফাইজের ঘন কালোচুল আর কপালের খানিকটা | ফাইজ একদম নিরব |

হঠাৎ শুভ্রা বলল,তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছি |

- কোথায়,দাও এখনি পড়ব |

- ধুর বোকা এখন নাতো,কাল পড়বে | আমি পড়িয়ে দেব |

- তোমার জন্য আপা কিনছে,আমি কিনতে পারিনি তবে রং বলে দিছি | তোমার বোধহয় পছন্দ হবেনা |

- সব পছন্দ হবে,সব...

- শাড়ি কিন্তু |

- আমি কি শাড়ি পড়তে পারি?

- রং কি জানো? আবছা নীল |

- সত্যি?

- হ্যা সত্যি,খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে |

- এই তোমার পাঞ্জাবিটার রং কি,শুনবানা?

- বল

- আবছা নীল,তোমাকে ভীষন সুন্দর লাগবে | আমরা নীল রাজারাণী সাজব,খুব মজা হবে |

- শুভ্রা,আমার উপর কি তোমার রাগটা গেছে?

- গেছিল তো,তুমিই আবার মনে করিয়ে দিলা |


ফাইজ চুপ হয়ে যায়,আবার কাদতে ইচ্ছে করছে |

সহ্য না করতে পারলে কেদেই ফেলবে | শুভ্রা তো আর আপার মত বকা দিবে না,নিশ্চয়ই ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে বলবে,কাদেনা সোনা |


_____________

লেখক- আশিক