হবিগঞ্জ জুড়ে ‘ভুতুড়ে মোবাইল কলের আতংক’ ! ‘কল রিসিভ করেই’ জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে কয়েকডজন মানুষ!

ভয়ানক অন্যরকম খবর September 8, 2016 2,332
হবিগঞ্জ জুড়ে ‘ভুতুড়ে মোবাইল কলের আতংক’ ! ‘কল রিসিভ করেই’ জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে কয়েকডজন মানুষ!

”আকস্মিক কারো মোবাইল ফোনে আসছে অদ্ভুতুরে এক কল আর সেই কল রিসিভ করার পরই অজানা কারনে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন মানুষ”! কোন ভৌতিক গল্পের অংশ বিশেষ নয় এটি। মোবাইলে আসা এমন ভুতুরে কল রিসিভ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন এমনকি গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন হবিগঞ্জের বেশ কয়েকটি উপজেলার প্রায় কয়েকডজন মানুষ। স্থানীয়রা কেও বলছেন ‘ভুতুড়ে কল’ আর কেও বলছেন ‘কারেন্ট কল’।


শুধু গ্রামের মানুষই নয়, আতংক ছড়িয়েছে শহরের অলি-গলিতেও। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে সবাই। শুধু হবিগঞ্জেই নয় অনলাইনে অবাধ প্রবাহহের কারনে একইসাথে এই ঘটনার সাথে আরও অনেক গুজবের ডালাপালা ছড়িয়েছে সারাদেশ সহ বিদেশে থাকা প্রবাসীদের মাঝেও।


ভুক্তভোগীগের বক্তব্যমতে, মোবাইলে ০০০০৪, ০০০০২, ০০০০৮ এই জাতীয় বিভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন আসার পর রিসিভ করেই কিছু না বলে চেতনা হারাচ্ছেন তারা। এরইমধ্যে গত দুদিনে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি চিকিতসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন অদ্ভুতুরে ফোন কল রিসিভ করে গুরুতর অসুস্থ্যজনেরা।




পুরো জেলা জুড়েই এই ‘গুজব’ এর ডালপালা ছড়াচ্ছে দিনকে দিন। আতংকিত হাজারো সাধারন মানুষ রীতিমত ফোন ব্যাবহার করতে ভীত এখন। তবে অদ্ভুতুরে এই সমস্যার কথা আসলেই কতটুকুন সত্য তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর যুক্তি-তর্ক আর জল্পনা-কল্পনা।


গত দুদিন ধরে নানাসুত্র থেকে সময়ের কণ্ঠস্বরের নিউজরুমে এমন খবর আসার পর আজ ‘আজব’ এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে সময়ের কণ্ঠস্বরের হবিগঞ্জ প্রতিনিধিকে সাথে নিয়ে চলে বিস্তর অনুসন্ধান।


অনুসন্ধানে জানা যায়, মঙ্গলবার সকালে লাখাই উপজেলার বুল্লা বাজারে রাধানগর গ্রামের খোকন মিয়ার ছেলে পলাশ মিয়া (২০) নামে এক যুবকের মোবাইলে ০০০০৪ নাম্বাররে ফোন আসার পর সে রিসিভ করার সাথে সাথেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর ঘটনার প্রায় ১৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে পলাশ মিয়ার ।


পলাশ মিয়ার দোকানের মালিক নির্মল বাবু বলেন, পলাশ বুল্লা বাজারে আদর্শ মিস্টান্ন ভান্ডারে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে আসছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে কাজ করার এক ফাঁকে তার মোবাইলে একটি কল আসে। এই কলটি রিসিভ করার পরই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। মাথায় পানি দেয়ার পরও তার জ্ঞান না ফিরলে তাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।



তিনি বলেন, আমি তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ০০০০৪ নাম্বার থেকে কল আসছিল। আমরা বেশ কিছু দিন ধরে শুনছি মোবাইল ফোনে কল আসার পর মানুষ মারা পর্যন্ত যায়। বিষয়টি সত্যি আজব উল্লেখ করে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন ।


এ সম্পর্কে জানতে অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ কিউজিএম ফারুকিকে সময়ের কণ্ঠস্বর থেকে ফোন করা হলে তিনি জানান, এধরনের গুজবের কথা তিনি শুনেছেন। ব্যাক্তিগত কাজে ঢাকায় থাকার কারনে ভালো মত সবকিছু জানাতে না পারলেও তিনি জানালেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে এমন আশ্চর্য ঘটনা প্রথমবার শুনছি।’


এমন আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি লাখাই উপজেলায়। সেই সুত্রে যোগাযোগ করা হয় লাখাই উপজেলা মেডিকেল অফিসার ডাঃ আব্দুল কাজী মান্নান এর সাথে । আলাপকালে তিনি সময়ের কণ্ঠস্বরকে জানালেন, স্ত্রীর আকস্মিক অসুস্থ্যতার কারনে তিনি এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।


এমন গুজবের কথা শুনেছেন কি না সময়ের কণ্ঠস্বরের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, গত কদিন ধরেই স্টাফরা এমন কথা জানাচ্ছেন তাকে। বিষয়টি স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চাননা তিনি নিজেও। জানালেন, তার সহকর্মীরা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন এসব ভুতুরে রোগীকে নিয়ে ।


এই প্রসঙ্গে কথা হয় হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নির্মল ভট্টাচার্যের সাথে। তিনি জানালেন, রোগীর স্বজনরা বলছেন মোবাইল ফোনে কল আসার পর সে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা বিষয়টি আগে গুজব মনে করেছিলাম। এখন দেখছি বিষটি খুবই অবাক এবং অবিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু ইদানিং এরকম বেশ কয়েকজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করছি সময় বেশি লাগলেও তিনি সুস্থ্য হবেন।”


যেভাবে ছড়াচ্ছে গুজবের ডালপালা

গত সোমবার রাত ৯টার দিকে হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর এলাকার আকবর আলীর স্ত্রীর মোবাইলে একটি ফোনকল আসলে তা রিসিভ করেন তিনি। এরপর কিছু না বলেই আকস্মিক অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। জুমা আক্তার (২৫) নামে এক গৃহবধুকে গুরুতর অবস্থায় তাকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।



স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জুমা আক্তারের মোবাইল ফোনে ২৮২৮ নাম্বার থেকে একটি ফোন আসে। পরে ফোনটি রিসিভ করা হলে কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে ফোনটি রিসিভ করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।


পরে সুস্থ্য হলে জুমা আক্তার জানান, ফোনটি রিসিভ করার পরই আমি অসুস্থতা বোধ করতে থাকি। আমার শরীরের হাত পা টানা শুরু করে। পরে তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।


এই প্রসঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় লাখাই সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিতসক ডাঃ এনামুল হক (এমবিবিএস)’র সাথে, তিনি জানালেন, গত দুদিনে প্রায় ৫ জন এমন আজব সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। প্রতিটি রোগিকেই দেখেছেন তিনি । প্রায় সবাই জানিয়েছেন একই রকম কথা ‘কল রিসিভের পরই অজ্ঞান হয়েছেন তারা’ ।


একজন চিকিৎসক হিসেবে এমন সমস্যার কোন ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে কিনা? সময়ের কণ্ঠস্বরের এমন প্রশ্নের জবাবে ডাঃ এনামুল হক জানালেন, সব রোগীদের পরীক্ষা করে তিনি যতটুকু বুঝেছেন, তাতে করে তারা সবাই আকস্মিক কোন কারনে ভীত হয়েছেন। রোগীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সহ সচেতনতার পরিমাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, প্রায় সব শ্রেনী পেশার মানুষই আক্রান্ত। অল্প শিক্ষিতরা যেমন আছে দু- একজন উচ্চ শিক্ষিতও আক্রান্ত হয়েছেন এই ‘ভুতুড়ে ঘটনায়’ ।


এ ঘটনার মুল কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ মিঠুন রায় জানান, এ ঘটনাটি গুজব। যা সাধারণ মানুষদের মধ্যে আতংক ছড়ায়।তিনি তাতে সাধারণ মানুষদেরকে আতংকিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।


এদিকে, শুধু পলাশ মিয়া আর জুমা আক্তার নয়, এমন অনেক ঘটনার কথাই ভাসছে হবিগঞ্জের বাতাসে। এসবের অধিকাংশই গুজব! নাকি সত্যি, এমন দ্বিধায় ভুগছেন লাখো মানুষ। এমন অবস্থায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মোবাইলের ভুতুড়ে আতংক! এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের সুষ্ঠু তদন্ত ও সাধারন মানুষের মধ্যে এই ঘটনার সঠিক বিশ্লেষণ খুব দ্রুত প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন এলাকাবাসি।