সোনালী মোড়কে মোড়া কষ্ট গুলো

ভালোবাসার গল্প September 3, 2016 3,232
সোনালী মোড়কে মোড়া কষ্ট গুলো

অপূর্ব সুন্দর চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘর। আটপৌরে মশারীর শরীর গলে সেই আলো চুইয়ে এসে পড়ছে বিছানায়। তার পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা রুপার মুখটা জোছনার আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দ্বীপ। পালিয়ে যাবার আগের রাতে হয়তো কোন মানুষই ঘুমাতে পারেনা।


হ্যাঁ, আগামীকাল সন্ধ্যায় পালিয়ে যাবে দ্বীপ। চলে যাবে এই মায়ার বাঁধন ছেড়ে। বড় পলকা হয়ে গেছে এই বাঁধন। নিজ থেকে কোন সময় ছিঁড়ে গিয়ে কিছু তিক্ততা সৃষ্টি করার আগেই পালিয়ে যাচ্ছে সে। যদিও সে নিজে ছাড়া ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছেনা কেউই। সব কিছুই চলছে ঘড়ির কাঁটা ধরে নিখুঁত ভাবে। নিজে কিছুটা এলোমেলো চললেও তার আশপাশটা গুছিয়ে রাখার, সামলে চলার চেষ্টা করে সে। কিছু কিছু পরিকল্পনা ঠাণ্ডা মাথায় বাস্তবায়ন না করলে বড় ধরণের ভুল থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকে, এক্ষেত্রে সে কোন ভুল করতে চায় না। তাই গত এক বছরে একটু একটু করে সে এগিয়েছে তার প্লান মাফিক। আগামীকাল সেই প্ল্যানের চূড়ান্ত দিন।


ভালবাসা অদ্ভুত এক বাঁধন। অজানা অচেনা একটা মানুষকে কি ভয়াবহ আকর্ষণে কাছে টেনে আনে ভালবাসা। তার কাছে মন খুলে সব কিছু বলা যায়, পরম নির্ভরতায় ধরা যায় তার হাত। নিজের সুখটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায় তখন, তার জন্য কিছু একটা করতে পারলে জীবন সার্থক মনে হয়। পাগলের মত তার মায়াভরা মুখটা, হাসিটা, চোখের তারায় ভালবাসাটুকু দেখতে ইচ্ছে করে। মনে মনে অস্ফুটে হাজারবার বলতে ইচ্ছে করে – ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি ...


প্রথম দেখায় কি প্রেম হয়? হয় না আসলে। শুধু আকর্ষণ জন্মে, মায়া তৈরি হয়। ডিমের ভেতরের কুসুমের মত, তুলতুলে গাঢ় মায়া। তার চারপাশে তখনও অনিশ্চয়তার মেঘ। হয়তো ভালবাসা হবে, হয়তো না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম দেখার ভাল লাগাটুকু অব্যক্তই থেকে যায়। কিছুদিন মন অশান্ত থাকে, পরে এক সময় এই সময়র কথা চিন্তা করে হাসি পায়। ঠিক এমনটাই কিন্তু হতে পারতো দ্বীপের জীবনে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা। প্রথমবার রুপাকে দেখার পর তার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়াই তৈরি হয়নি। আর দশটা সদ্য পরিচিত মেয়ের বাইরে কিছুই মনে হয়নি সাদা জামা পড়া, লিকলিকে মেয়েটাকে। স্বভাব সুলভ ভাবে দূরত্ব বজায় রেখে গেছে, কথাও বলেনি বেশী। কিন্তু পরিচয়ের কয়েকদিনের মাথায় দ্বীপের মনে হয়েছে এই মেয়েটা ভেতর ভেতর অনেক একা। তার সাথে থাকা চটপটে আধুনিক মেয়েগুলোর মত প্রগলভ নয় সে, নয় জামা কাপড়ে উগ্র আধুনিকা। তবুও কেমন যেন একটা স্নিগ্ধতা ঘিরে থাকে রুপাকে। এখনও সেই স্নিগ্ধতাটুকু ঘুমন্ত রুপার মুখে এখনও দেখে দ্বীপ। তার খুব ইচ্ছে করে রুপার গোলাপ ঠোঁটে একটা চুমু খায়, কিন্তু না, সেদিনের সেই রুপা আর আজকে তার ঘুমন্ত স্ত্রী রুপার মাঝে যোজন যোজন তফাত।


কি আশ্চর্য সুন্দর ছিল সেই সময়গুলো। প্রতিদিন খুব সকালে উঠে গোসল সেরে বেড়িয়ে যাওয়া। এরপর এক সাথে ব্রেকফাস্ট করে রুপাকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে ক্লাসে যেতো দ্বীপ। যার আগে ক্লাস শেষ হতো, সে অপেক্ষা করতো অন্যজনের জন্যে। ক্লাসমেটরা খেপাতো দুজনকেই। তাতেও লজ্জা মাখা আনন্দ ছিল। প্রতিটা দিন যেন নতুন আনন্দে ভরে থাকতো। সবার চোখ এড়িয়ে হাত ধরা, পাশাপাশি হাঁটার সময় একটু বেশী কাছে চলে আসা। দ্বীপের হাত জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্ত পদক্ষেপে চলা রুপার অস্তিত্ব, রুপার সুগন্ধ খুব বেশী ভাল লাগতো তখন। এখনও লাগে, এখনও সদ্যস্নাতা রুপাকে সুযোগ পেলেই জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে দ্বীপ, ফলাফল বেশীর ভাগ সময়েই – এক ধাক্কায় কুপোকাত। নাহ ... রুপাকে সে কিছুই বুঝতে দেয়নি। মেয়েটা জানতেও পারেনি কত বড় ক্ষতি সে করে ফেলেছে।


সম্পর্কের ছয় মাসের মাথায় যেদিন রুপা ওকে বললো “চলো বিয়ে করে ফেলি”, শুনে দ্বীপ কেমন যেন একটা ধাক্কা খেয়েছিল মনে মনে। প্রেম আর বিয়ের মধ্যে অনেক তফাত। প্রেম তো শুধু মুক্ত বিহঙ্গের মত ওড়া উড়ি, আর বিয়ে অনেক বড় একটা দায়িত্ব। আমাদের সমাজে নিজের পছন্দের ছেলে বা মেয়ের ব্যাপারে বাবা মাকে রাজী করানোটাই দূরহ ব্যাপার। কোন এক অজানা কারণে বাবা মা সব সময়েই ধরে নেন যে তার সন্তানের পছন্দের ছেলে বা মেয়েটি মোটেও ভাল না। এই অবস্থা থেকে তাদের রাজী করানোতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়। তারপর শুরু হয় আত্মীয়স্বজনের আজব সব যুক্তি দিয়ে বিয়ে বন্ধ করবার পায়তারা। কখনও মেয়ের বাবার দূর সম্পর্কের ভাইয়ের মাথা খারাপ ছিল, কখনও ছেলের ফ্যামিলিতে একজন হত-দরিদ্র মানুষ আছেন – এই ধরনের আজব সব ইতিহাস বের হয়ে আসে তখন। সবার ক্ষেত্রেই মোটামুটি এমনটাই ঘটে। তাই “বিয়ে করে ফেলি” বলাটা যত সহজ, সেটাকে কাজে পরিণত করাটা তার চাইতে শতগুণ বেশী জটিল।


কয়েকদিন পরে রুপাই বলেছিল ওর রুমমেট অলরেডি বিয়ে করে ফেলেছে, কিছুদিনের মধ্যেই আলাদা বাসা নিয়ে হল ছেড়ে দেবে ওরা। শুনে বেশ সাহস পায় দ্বীপ। আসলে একটা বয়স থাকে, যখন নিয়ম ভাঙ্গাটাই আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর ভালবাসার মানুষটাকে কাছে পাবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাটা তো আছেই। ব্যাপারটা সবটুকুই শরীর নির্ভর নয় অবশ্যই। ভালবাসার মানুষটির সাথে সারাক্ষণ থাকাটাই মুখ্য।


এরপর কত হিসেব নিকেশ করে, বুঝে শুনে, স্বপ্ন বুনতে বুনতে একদিন ওদের বিয়েটাও হয়ে গেল। সেদিন কোর্টের হলফ নামায় সাইন করার সময় ওদের প্রিয় বন্ধুরা সাথেই ছিল। দ্বীপ সাইন করে দিয়েছিল সাথে সাথেই, রুপাই যেন থমকে গিয়েছিল কলম হাতে নিয়ে। ওর চোখে মুক্তোর মত জমেছিল অশ্রু, গড়িয়ে পড়েছিল গাল বেয়ে। বন্ধুবান্ধব সবাই সরে গেল এই দৃশ্য দেখে, পার্কের বিশাল ছাতার নীচে তখন রুপা আর দ্বীপ, সামনে অনাগত অদেখা ভবিষ্যৎ, ভরসা শুধু – দুজনের চলার পথটা এক।


সেদিন বিকেলে মসজিদের ইমাম সাহেবের বাসায় গিয়ে যখন ধর্ম মতে বিয়েটা পড়ানো হলো, তখন রুপা একেবারে নববধূ। লজ্জা মাখা চাহুনী, মাথায় ঘোমটা টেনে হয়ে উঠেছিল এক্কেবারে নতুন একটা বউ। দ্বীপ তখন এক আকাশ আনন্দে ভাসছে, নিজেকে হটাতই খুব পরিণত আর দায়িত্ববান বলে মনে হচ্ছিল ওর। এরপর সবাই মিলে একসাথে ডিনার করতে যাওয়া। খুব আনন্দ করা হয়েছিল সেদিন। ডিনার শেষে হোটেলের ছোট্ট রুমে বাসর। রুপার বান্ধবীরা পাঁচ মিনিটে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল বিছানাটা। গায়ে হলুদের রঙ পড়েনি ওদের গায়ে, সাজানো স্টেজে গয়না মোড়া বউ হয়েও বসতে পারেনি রুপা, ওর বিয়ের উপহার ছিল ছোট্ট একটা স্বর্ণের নাক ফুল আর এত্ত এত্ত ভালবাসা।


বিয়ের পর সব কিছুই হয়তো বদলে যায়। আর এই বদলে যাওয়াটাই এক সময় খুব প্রকট হয়ে ধরা দেয় চোখে। আশাহত হয় দুজনেই। কিন্তু এটাই নিয়ম, এটা অবশ্যম্ভাবী, এটাই হয়, সবার ক্ষেত্রেই হয়। বিয়ের আগে প্রেমের মুহূর্তগুলো কাটে স্বপ্নে স্বপ্নে, বিয়ের পর সেই স্বপ্নটা ফিকে হতে থাকে। আসলে – বিয়ের আগে তীব্র একটা চাওয়া থাকে দুজন দুজনকে কাছে পাবার। যতবার দেখা হয়, সুন্দর পোষাকে সেজে গুজে আসে দুজনেই। নিজেদের ছোটখাটো দোষ ত্রুটি গুলো লুকিয়েই রাখে তারা। ছোট ছোট উপহারে একে অন্যকে চমকে দিতে পছন্দ করে। আর বিয়ের পর সকালে জেগে উঠে ঘুমুতে যাওয়া পর্যন্ত আটপৌরে মানুষ দুটো থাকে এক সাথে। ক্রমে ক্রমে কমে আসে ভালবাসার সেই তীব্রতা। জন্ম হয় আজীবন পাশে থাকার, নির্ভরতার, বিশ্বাসের একটা নতুন অধ্যায়। ছেলেরা চিন্তা চেতনায় আর দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত হয়ে যায় সংসার চালানোর খরচ যোগাতে, আর মেয়েরা তখন হয়ে ওঠে পুরোদস্তর গৃহিনী। সকালে নাস্তা কি দিয়ে হবে, বাজার থেকে কি আনতে হবে, কি রান্না হবে, এসব প্র্যাক্টিকাল বিষয় গুলো প্রাধান্য পেতে থাকে জীবনে। ফলে ভালবাসার সময়ের সেই কপোত কপোতী ভাবটা আগের মত আর থাকে না। একটা সময় দুজনেই খেয়াল করে, তাদের জীবনটা কোথায় যেন থেমে গেছে। দুজনেই অনুভব করে – ভালবাসাটা আর আগের মত নেই। শুরু হয় অভিযোগ, জন্ম নেয় অভিমান। আসলে বদলে গেছে দুজনেই। নিজের পরিবর্তনটা চোখে পড়েনা কারওই।


রুপা আর দ্বীপের জীবনেও ঠিক এমনটাই ঘটতে লাগলো। বুকের মাঝে অভিমানের পাহাড় গড়ে দুজনেই পথ চলতে লাগলো। এক রাতে এক কথা দু’কথায় বেড়িয়ে এলো রুপার চাঁপা অভিমান। স্তব্ধ হয়ে শুনে গেল দ্বীপ। অনুভব করলো, রুপার বলা কথা গুলো মোটেও মিথ্যে নয়। তবুও মুখ ফুটে বলতে পারলো না রুপার ব্যাপারে জমে ওঠা তার অভিমানের কথা। মায়া বড় আজব অনুভূতি। রুপার অভিযোগ গুলো শুনে ওর যেমন কষ্ট লাগছে, সে চায়নি রুপাকেও ঠিক এভাবে কষ্ট দিতে। বরং এর পরের সময়গুলোতে সে চেষ্টা করেছিল নিজেকে বদলে ফেলার, আবার আগের মত সুন্দর সময়টাকে ফিরিয়ে আনবার।


সবার জীবনেই কিছু অতীত থাকে, যেটা মেনে নিতে হয়। ওদের দুজনেরই হয়তো ছিল, ওরা মেনেও নিয়েছিল সব। কিন্তু একদিন – সেদিন রুপা ছিল ইউনিভার্সিটিতে, ওর ফেরার সময় পেড়িয়ে যাওয়ায় দ্বীপ হাটতে হাটতে এগুচ্ছিল ইউনিভার্সিটির দিকে, এমন সময় রুপাকে সে দেখতে পেলো বড় দিঘীটার পাড়ে, একা। দ্রুত হেঁটে রুপার কাছে গিয়েই দেখে ওর চোখ ভরা জল। দ্বীপের পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে গেল যেন মুহূর্তেই। যে মেয়েটা পরম নির্ভরতায় তার হাত ধরে তার সাথে চলে এসেছে, তার চোখে অশ্রু আসবে কেন? কি করেছে দ্বীপ? সে তো চেষ্টা করেই যাচ্ছে আগের মত করে রুপাকে সময় দেবার, নিজের ভুল গুলো শুধরে নেবার।


সেদিন রাতে কিচ্ছু খায়নি রুপা। বিছানায় বসে বসে কেঁদেছে শুধু। এক সময় বলেছে তার মন খারাপের কারণ। যে ছেলেটাকে রুপার ভাল লাগতো, সে ভার্সিটি ছেড়ে যাবার সময় রুপাকে তেমন কোন আশ্বাস দিয়ে যায়নি। ওদের মাঝে সম্পর্কটা ফরমাল হতে হতেও হয়নি তখন, শুধু দুজনেই জানতো – ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসে। কাজেই এক্ষেত্রে কমিটমেন্টের কিছু ছিলও না হয়তো। সেই ছেলেটা চলে যাবার পর রুপার সম্পর্ক ও বিয়ে হয়ে যায় দ্বীপের সাথে। এটা রুপার খুব ক্লোজ কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কেউ জানতো না। যা হোক, আজ প্রায় এক বছর পেড়িয়ে যাবার পর সেই ছেলে চিঠি দিয়েছে রুপাকে। ছেলেটা ভাল একটা জব পেয়েছে। এখন সে তৈরি রুপাকে বিয়ে করে ঘরে নেবার জন্য। সে কারণে রুপার ভাষায় – তার ‘মরে যেতে’ ইচ্ছে করছে এখন।


ভালবাসার মানুষকে আর যাই হোক, কারও সাথে শেয়ার করা যায় না, এক বিন্দুও না ...


দ্বীপ আচমকা খুব বড় একটা আঘাত পেয়েছিল সেদিন। কিন্তু কিছুই বুঝতে দেয়নি রুপাকে। সারাটা রাত ওকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। কারণ দ্বীপ জানে, রুপা তো এখন তার। ছেলেটা রুপার অতীত। যে গেছে, সে চলেই গেছে, সে আর রুপার জীবনে ফিরে আসবে না।


পরবর্তী দিনগুলোতে দ্বীপ চেষ্টা করে গেছে রুপাকে আরও বেশী ভালবাসায় ভরিয়ে দেবার। একটা সময় সে ভেবেছে যে ওই ছেলেটার ছায়া সরে গেছে রুপার মন থেকে।


এরপর অনেক ঘটনায় অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে। না না ঝামেলা করে দুজনার পরিবারকে রাজি করানোও গেছে। কোন এক শুভ মুহূর্তে রুপাকে সে তুলে এনেছে তার ঘরে। রুপা এখন তাদের বাসাতেই থাকে। কিন্তু চাকুরীর কারণে দ্বীপকে চলে যেতে হয়েছে অন্যখানে। নতুন চাকুরী, যে বেতন দেয় তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকা সম্ভব নয় বলে একাই গেছে যে। তবুও প্রতি সপ্তাহে বাসায় আসে দ্বীপ, আর লক্ষ্য করে রুপা কেমন যেন বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে আরও। কারণে অকারণে রুপা অনেক বেশী রিএক্ট করে এখন। খুব বেশী রাগ করে আর কেমন যেন আনমনা থাকে সারাক্ষণ।


ক্রমে ক্রমে অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়ায়, দ্বীপ সময় গোনে, রুপা ঠিক কতক্ষণ ওর সাথে রাগারাগি করেনি। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে সে, এই বুঝি রুপা রেগে গেল। সপ্তাহ শেষে ফিরে যাবার সময় হলে দ্বীপ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। রুপার কাছ থেকে দূরে গিয়েই যেন ভাল থাকে। যতক্ষণ ফোনে কথা হয়, ততক্ষণ রুপা সেই আগের মতই, তার লক্ষ্ণী বউটা হয়ে থাকে। কিন্তু কাছে এলেই সব ওলট পালট হয়ে যায়।


দ্বীপ যেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি, সেটাই ঘটলো এক সময়। পর পর দু তিন দিন রাতের বেলা ফোন দিয়ে দ্বীপ রুপার ফোন বিজি পায়। বাসায় এসে একদিন দেখে অনেক রাতে রুপা উঠে গিয়ে বারান্দায় এক কোণে বসে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আগে ও এমনটা করেনি, কিছু যেদিন করলো, সেদিনই দ্বীপ টের পেয়ে গেল কিছুটা। কয়েক ঘণ্টা পর রুপা বাথরুমে গেলে দ্রুত হাতে দ্বীপ টুকে নিলো লাস্ট কলের নম্বরটা। পরের দিন ওই নম্বরে কল দিয়ে জেনে গেল এটা সেই ছেলেটার নম্বর, যার সাথে রুপার সম্পর্ক হতে হতেও হয়নি।


এরপরের দিনগুলো দ্বীপের জন্য ছিল চরম যন্ত্রণাদায়ক। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে সে, বুঝিয়েছে রুপা এখন তার বিবাহিতা স্ত্রী। নিজের স্ত্রীর উপর অবিশ্বাস করবার কারণে আত্মদহনটাও নেহাত কম ছিল না। তবুও এ জ্বালা বড় বেশী কষ্টদায়ক। সে বার একদিন ছুটি নিয়ে আগেভাগেই বাসায় চলে আসে দ্বীপ, এক সময় রুপাকে জিজ্ঞেস করে ওই ছেলেটির কথা। রুপা স্পষ্টতই এড়িয়ে যায়, বলে – সেই ছেলের সাথে ওর কোন যোগাযোগ নেই। উলটো দ্বীপকে পুরনো কথা মনে করেছে বলে না না কথা শুনিয়ে দেয়, প্রচণ্ড রাগে এক সময় বাসা ছেড়ে চলে যাবার হুমকিও দেয় রুপা। দ্বীপ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বুঝতে পারে, সে আর তার পুরনো অবস্থানে নেই। তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তৃতীয় একজন ওদের জীবনে ভাল ভাবেই ঢুকে পড়েছে।


ছেলেদের মধ্যে দুই ধরনের মানুষ থাকে। একদল কেড়ে নিতে পছন্দ করে, আরেকদল করে না। ওরা দেবতার মত, সঠিক নৈবদ্দ্যে তুষ্ট। প্রয়োজনে কিছুই নেবে না, তবুও হাত পাতবে না কারও কাছে। দ্বীপ দ্বিতীয় দলের মানুষ। রুপার এই পরিবর্তনে ওর ভেতরটা ভেঙ্গে চুড়ে গেলেও সে কাউকেই কিছু বুঝতে দেয় না, রুপার প্রতি স্বামী হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে তার কর্তব্যতে একচুল পরিবর্তন আসে না। শুধু মনে মনে সে জানে, এক বিছানায় ঘুমিয়েও রুপা চলে গেছে শত মাইলের দূরত্বে।


প্রতি সপ্তাহে দ্বীপ বাড়ী ফেরে, একটু একটু করে রুপার বদলে যাওয়া দেখে। রুপা এখন প্রতি রাতে কয়েক ঘণ্টা কথা বলে ওই ছেলেটির সাথে। যেন লুকোচুরির আড়ালটাও ভেঙ্গে গেছে। যদিও দ্বীপকে সে বলে, দ্বীপের অনুপস্থিতির কারণে বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা বলাটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে, তবুও দ্বীপ তো জানে সত্যিটা। সেই সময় থেকেই দ্বীপের পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা।


দূরের কোন মসজিদের আজানের শব্দ ভেসে আসে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই দ্বীপ তার চেনা পরিবেশ ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূরে। সবাই জানে বাইরের দেশে পড়তে যাচ্ছে সে। কিন্তু সে নিজে জানে, আর কোন দিনই তার ফেরা হবে না এদের কাছে। দূরে চলে গিয়ে সে এক সময় মুক্ত করে দেবে রুপাকে। কাছে থেকে এই কাজটা করা অসম্ভব। অনেক বেশী ভাল সে রুপাকে বাসে। কিন্তু রুপা ... যে তার এই ভালবাসার বাঁধনে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারেনি, বরং জড়িয়ে গেছে অন্য একটা মোহের জালে, তাকে ডেকে ফেরানো অসম্ভব। ভাঙ্গা আয়নার মত ভাঙ্গা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না।


কিছু কিছু মানুষ এমন হয়। তারা জানে যে তারা ভুল করছে। তুচ্ছ কারণে দিচ্ছে অনেক বড় মূল্য। নিজের হাতে নষ্ট করতে যাচ্ছে তার নিজের জীবন। তবুও ... তারা কিছুতেই ফেরাতে পারেনা নিজেকে।


কিছুতেই না ...