হাঁসি, কান্না, ভালোবাসার “অজ্ঞাতনামা (২০১৬)”

মুভি রিভিউ August 23, 2016 3,180
হাঁসি, কান্না, ভালোবাসার “অজ্ঞাতনামা (২০১৬)”

অজ্ঞাতনামা, নামের ভিতর লুকিয়ে আছে পুরো সিনেমাটি। অজ্ঞাতনামা নিঃসন্দেহে এ বছরের অন্যতম সেরা বাংলা সিনেমা। দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির এক বিশাল অংশ আসে প্রবাসী বাঙ্গালীদের থেকে। বিশাল অর্থনীতির চাকা যারা সচল করে রেখেছে তাদের কথা বা সুযোগ সুবিধার কথা কতটা মাথায় রেখেছে আমাদের সরকার। শুধু দেশের জনশক্তি রপ্তানী করেই দায়িত্ব শেষ মনে করে তারা, কিন্তু সে জনশক্তি বিদেশে যখন মারা যায়, তার লাশটি কি পরিবার পর্যন্ত আসে? লাশ আনার দায়িত্ব কার? আমার আপনার নাকি সরকারের?


কাহিনীতে ফুটে ওঠে, ফজলুর রহমান বাবুর ছেলে মধ্য প্রাচ্যে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ধরেই তার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। থানার ওসির কাছে খবর আসে আব্দুল হাকিম নামে একজন আজমান শহরে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। খোঁজ নিয়া দেখা যায় আবুল হায়াতের ছেলে ৩ দিন আগে মারা গেছে। কিন্তু আবুল হায়াত গতকাল ও তার ছেলের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে । সমস্যা টা হয় ঠিক তখন। আবির্ভাব হয় পর্দায় রমজান দালাল রূপী শহিদুজ্জামান সেলিমের। কম টাকার বিনিময়ে গলা কাঁটা পাসপোর্টে বিদেশে লোক পাঠায় সে। আর ঝামেলা বাধে এখানেই ফজলুর রহমান বাবুর ছেলে আবুল হায়াতের ছেলের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে যায় ভাগ্যের সন্ধানে। এইজন্য লাশের নাম আর পিতার নাম নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। ফজলুর রাহমান বাবু তার ভাতিজা ও রামজান দালাল কে সাথে নিয়ে লাশ আনার জন্য রওনা দেয় ঢাকায়। কিন্তু লাশ কি তারা পাবে? দেখায় যাক না কি ঘটে।


সিনেমটি আর্ট ফিল্ম হিসাবে ভাবা গেলেও তা কমার্শিয়াল সিনেমা থেকে কম নয়। যদি ভেবে থাকেন অজ্ঞাতনামা নামটি তো বেশ গুরু গম্ভীর, সিনেমা হয়তো আরো বেশি গুরু গম্ভীর। জীবনের সব থেকে বড় ভুল করবেন তখন, সিনেমার প্রথম অর্ধ পুরো এন্টারটেইন্টিং আর এন্টারটেইন্টিং। ডায়গল এক্সপ্রেশন আর অভিনয় দিয়ে পুরো সময় মাতিয়ে রাখবে আর দ্বিতীয় অর্ধ, সেটা তো আরো বেশি থ্রিলিং, কি হবে কি হবে এমনভাবে রাখবে। তাই আপনি কোনভাবে বোরিং ফিল করবেন না। সিনেমা হল ভর্তি মানুষ হেসেছে সিনেমা দেখতে দেখতে, আবার আবেগাপ্লুত হয়েছে ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় দেখে।


শহীদুজ্জামান সেলিম ও মোশারফ করিমের নিজেদের মাঝে কথার লড়াই আপনাকে সব সময় মজার মাঝে রাখবে। সিনেমটি আসলে প্রপার কাস্টিং এ পরিপূর্ণ। ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশারফ করিম, শতাব্দী ওয়াদুদ, আবুল হায়াত, নিপুন এতোগুলো স্টার যেখানে সেখানে অভিনয় দক্ষতা নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। শহীদুজ্জামান সেলিম আবার প্রমাণ করেছেন তিনি কত বড় মানের অভিনেতা, আসলে এখানেই একজন জাত অভিনেতা ও লাইক সবর্স্ব অভিনেতার মাঝে পার্থক্য। দূর্ভাগ্যের কথা হল আমরা এমন অভিনেতা না দেখে লাইক বেশি পাওয়া অভিনেতা নিয়ে কথা বেশি বলি। নিপূণের এক্সপ্রেশন কম না বেশিও না।মোশাররফ করিম, শহীদুজ্জামান সেলিম-দের মতো পেশাদার অভিনেতার সাথে স্বাভাবিক অভিনয়টা করে নিজেও পেশাদার অভিনেত্রীর কাজটা ভালোমতোই দেখায়। তার চরিত্রটি সিনেমায় একটা বার্তা, যার প্রয়োজন অনেক।সমাজে ভুল সিদ্ধান্ত বা অাকাশ কুসুম স্বপ্নকে ঘিরে বাস করা মানুষের চেতনা ফিরে পাবার বার্তা।এই মাল্টিস্টারার সিনেমার চরিত্রদের অালাদাভাবে অভিনয়ের যথেষ্ট স্পেস দিয়েছেন তৌকির অাহমেদ।কথা হচ্ছে নির্মাতা যদি পারফেক্ট হয় তবে স্টার একটা সিনেমায় যতই হোক না কেন তাদের অভিনয়ের জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না।


অজ্ঞাতনামা শুধু একটি সিনেমা নয় একটি দর্পন, সমাজের দর্পণ। আসলে একবার ভাবেন তো একটা লাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, আপনি কার কাছে যাবেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? শ্রম মন্ত্রণালয়? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়? কার কাছে যাবেন? এক মন্ত্রণালয় বলবে এটা আমার নয় উনার। কিন্তু সমাধান কি তাহলে? রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারবেন কিন্তু তারা মারা গেলে একটু ভালো সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন না? একটু ভাবুন, এখনি সময়।


চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় নিজের প্রকাশিত হওয়া অজ্ঞাতনামা বইয়েরই চলচ্চিত্রায়ন। চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালের ১৭ মে ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসব-এ প্রদর্শিত হয় এবং জুরি স্পেশাল মেনশন পুরস্কার অর্জন করে।চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকার হিসাবে তৌকির আহমেদের চলচ্চিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এছাড়া চলচ্চিত্রটি ইতালির গালফ অফ ন্যাপলস ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে ২১ মে প্রদর্শিত হয় এবং সেরা ফিকশন চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়।

পরিচালক তৌকির আহমেদ দারুণ ভাবে সমস্যাটি তুলে ধরেছেন। এতো চমৎকার থিম নিয়ে সিনেমা হতে পারে ভাবা যায় না আসলে। আমার দেখা তৌকির আহমেদ এর সেরা সৃষ্টি অজ্ঞাতনামা। একবার দেখে আসুন, না দেখলে অনেক কিছু মিস করে ফেলবেন।


মাই রেটিংঃ ৮.৫/১০