ছুঁয়ে জোছনার ছায়া

জীবনের গল্প August 19, 2016 4,268
ছুঁয়ে জোছনার ছায়া

মরিয়ম বেগম পান খাচ্ছেন | এসময়টা তার দিনের মধ্যে একটা অমূল্য সময় বলা যায় | যে পরিমাণে পান খায়,তাতে যা মনেহয় মাসে ১০০০ টাকা খরচই হয় তার পানসামগ্রীর পিছনে | যদিও তার টাকার কোন চিন্তা নেই |

দরজা ঠেলে অর্নবের উকি দেয়া মাথাটা দেখে একটু বিরক্তিস্বরে বললেন,কিছু চাও?

- আম্মা আমি কি ভিতরে আসব?

- বাইরে দাড়াইয়া কথা বলা আমার অপছন্দ,জানোনা?

অর্নব দরজাটা আগের মত চাপা দিয়ে এসে মায়ের পায়ে কয়েকবার সালাম করে হেসে দিল |

- হাসো কেন,কি ঘটনা?

- আম্মা আমার একটা চাকরি হইছে,তবে ততটা সুবিধার না | যেকোন সময় ছেড়ে দিতে পারি |

- শুরুর আগেই ছাড়াছাড়ির কথা বলতেছ কেন,গাধা কোথাকার ! বাপের মত হইছ !

অর্নব হাসিটা এখনো থামায়নি,ভালই লাগছে হাসতে |

- বোকা ছেলে,খালি হাসে | আমার এইপাশে পা উঠাইয়া ভালমত বস |

কথামত অর্নব তাইই করল | মায়ের গা ঘেষে একটু আদুরে ভঙ্গিতে |

- পান খাবা আব্বা? নতুন এক মশলা আনাইছি,খুব মজা | দাড়াও একবার খাও,তাইলেই মজা বুঝবা |

অর্নব কেবল মাথা দুলিয়ে চলেছে |

ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছে,কতদিন পর মা ওকে 'আব্বা' বলে ডেকেছে | ডাকটা শুনলেনা গলা কেমন ভার হয়ে আসে | অতি আবেগেই হয়ত |

- অর্নব,তোমার দু'ভাইদের খবর কি,তারা কেমন আছে?

- আম্মা আপনি সারাদিন বাসায় থেকে আমাকে এই প্রশ্ন করতেছেন কেন |

- তারা তো আমার সামনেই আসে না | চাকরি বাকরি,বউ পোলাপান নিয়ে ভারি ব্যস্ত | আমার কাছে আসার সময় কই? তুমিও কি বাসায় থাকো না?

- আগামী ৭ দিন মানে ১ সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় আসি নাই | কারণ এইরকম বাজারের মত বাসায় থাকতে একদম ভাল্লাগেনা |

- ও,ভাল বলছ |

- আম্মা আমার টিউশনি আছে,গেলাম |

- পানটা খাবা না?

- জ্বি দেন,খেতে খেতে যাই |


শুধুমাত্র বসার ঘরটাই এত্ত সুন্দর করে কেউ সাজাতে পারে বিশ্বাস করাই কষ্টকর | বাব্বাহ্,এইনা হল বড়লোকি বাসা |

টানা কয়েক মাসেও এই রুমের উপর একটুও বিস্ময় কমেনি অর্নবের | পড়াতে এলেই মনে ওলটপালট লেগে যায় রুমের প্রতিটা বস্তু দেখে |

তবে টাশকি খাওয়া কথা হল,বড়লোক সাহেবের একমাত্র সন্তান এবং মেয়ে মানে তাশফি | এই মেয়ের কথাবার্তা,চালচলন তো পুরাই উল্টা |

ক্লাস টেন পড়ুয়া এই মেয়ের সাথে চললে কে বুঝবে,এযে বিরাট রাজার একমাত্র রাজকন্যা | তবে অর্নবের অতটা টাশকি খেতে হয়নি |

কারণটা ওর স্বভাবের | ওর খালি ঐ জড় চাকচিক্যের প্রতিই মনোযোগ অত্যধিক | চাকচিক্যের ভেতরের জীবদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই |


"স্যার বসে আছেন কেন,রুমে আসেন"

তাশফির ডাকে ঘোর ভাঙল অর্নবের,হ্যা আসছি |

তাশফিকে দেখে অর্নব এক নিরব ঝামেলায় পড়ে গেছে |

ঝামেলার কথাটা তো আর সরাসরি বলা যাবেনা,চুপ করে থাকাই নিরাপদ | তাই একে নিরব ঝামেলাই আখ্যা দিয়ে ফেলল অর্নব |

আজ হঠাৎ এরকম কেন হয়ে গেল কে জানে | আসোলেই চোখ সামাল দেয়ার মত কঠিন কাজ,পৃথিবীতে খুব কমই আছে | ধ্যত্তরি যত্তসব !

- স্যার আপনার কি কিছু হয়েছে?

একটু চমকে অর্নব বলল,নাহ্ কি হবে? কিছু না |

ইচ্ছেকৃত হাসিটা দিতে গিয়েই ভালই ধরা খেল বেচারা |

- স্যার মিথ্যা বলা মহাপাপ জানেন না? আচ্ছা,আমি বলি আপনার কি হয়েছে? - বল

- আমি আজ শাড়ি পড়েছি,আপনার প্রিয় রঙের | চোখে কাজল দিয়েছি খুব যত্ন করে,এটাও আপনার পছন্দমত | আর এতে আমাকে খুব সুন্দর লাগছে তাই আপনি চোখ নামাতে পারছেন না |

অর্নবের মুখ মিডিয়াম হা হয়ে গেছে | এত নরম ভাবে চরম ধরা জীবনে এই ফাস্ট | ও খোদা,এইটা কি মেয়ে না মহিলা ফেরেশতা !


২.

হামিদ সাহেব রুমে ঘুরেঘুরে কথা বলছেন | একা একা,নিজের সাথে | যখন ভীষন একা মনেহয় এই পৃথিবীতে,তখনি তিনি এরকম করতে থাকেন |

ফলাফল,তিনি একটু একাকিত্বের মাঝেও সান্ত্বনা খুজে পান |

দরজায় খটখট শব্দ হতেই কথা থামিয়ে দিলেন | তিনি মোটামুটি অবাক আর কি |

আমার কাছে কি কারো আসার কথা ছিল,কে আসবে?

আরেকবার শব্দ হল,খট খট খট ! হামিদ সাহেব তড়িঘড়ি করে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেললেন |

- আব্বা কেমন আছেন?

হামিদ সাহেব যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না অর্নব এসেছে |

- এতদিন পর বাপের কথা মনে হল তোর |

অর্নব টুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে একদম সটাং হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় | খুব ঘুম পাচ্ছে ওর |

- কিরে বেটা অসুস্থ নাকি?

- নাহ্

- তবে শুয়ে পড়লি যে? আচ্ছা শুয়ে থাক,তোর জন্য লেবু চা করে নিয়ে আসি | আজ সকালে বাজার থেকে কিনেছি,একদম টাটকা লেবু |

হামিদ সাহেবের ভীষন আনন্দ লাগছে | বাড়ি ছাড়ার পর একমাত্র এই ছোট ছেলেটাই তার খোজখবর রাখে | একদম ভালমত রাখে,কি লক্ষী একটা |


চায়ের কাপে টানা দু'চুমুক দিয়ে অর্নব বলল,আব্বা আপনি না একা থেকে ভালই আছেন | আমিও আর থাকব না ভাবতেছি |

- তাইলে থাকবি কই?

- খালিদের বাসায় | কয়েকদিন ধরে তো ওর বাসাতেই আছি | আমার বন্ধুরা তো আর আমার মত বোকা না আব্বা | ওরা সবাই যে যার মত টাকা পয়সা কামিয়ে একদম পেটফোলা বড়লোক |

- বাদ দে ! তুই যেমন আছিস খুব ভাল আছিস | সততাই সবকিছুর আগে |

তারপরের কয়েকমিনিট কেটে গেল অস্বাভাবিক নিরবতায় | হামিদ সাহেব গভীর মনোযোগে ছেলেকে দেখছেন | চেহারায় কার যেন ছায়া আছে |

কার হতে পারে? মরিয়মের নাকি ওর দাদির?

যার মতই হোক,অর্নবটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে | দেখলেই সুপুরুষত্বের তৃপ্তি এসে যায় |


৩.

বসার ঘরে চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে গেল অর্নবের | আজ রাতে চাদঁ এর বদলে সূর্য উঠবে নাকি | ভাই-ভাবি,পোলাপান দেখি সব একখানে |

মেজভাবি ওকে দেখা মাত্রই শুরু করে দিল সুপরিচিত ঘ্যানানি,এইযে টো টো বাবাজি বাইরে বাইরে কি কর সারাদিন? মদ জুয়া আর কত !

অর্নব খেপলো না,একদমই না | একটুতেই খেপার পাত্র ও নয়,বরং কেমন মজা লাগছে |

- তোমার আম্মাজানকে পাওয়া যাচ্ছে না দুপুর থেকে |

- হয়ত বাজারে গেছে আপকামিং পান মশলার খোজ করতে | এসে পড়বে সময়মত |

- তা হলে তো হতই,কিন্তু চিঠি লিখে গেছে একটা !

- কি লিখছে? আমি বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি,আর আসব না | এই টাইপের?

- হুম

-ও,তবে আমার এসে তো কোন কাজ হল না | আম্মার কাছেই আসছিলাম,পান খেতে | হরেক মশলা দিয়ে পান,খুব খেতে ইচ্ছে করছিল | থাক,যাই |

মেজভাবি রাগে কটমট করছেন,যতসব আহাম্মকের পাল্লায় পড়েছি আমি ! বাড়ির সবগুলা একেকটা আস্ত আহাম্মক !


সোফার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা অর্নবকে দেখছে তাশফি,অনেকক্ষন ধরে | অর্নব মাথা নামিয়ে আছে, তাশফিকে দেখতে পায়নি |

তাশফির খুব,একদম ভীষনভাবে ইচ্ছে করছে এই বোকাসোকা চেহারার ছেলেটাকে অনেক আদর করতে,ইচ্ছেমত |

হঠাৎ এরকম ইচ্ছে হওয়ার কারণটা ও নিজেই জানেনা,অত জানতে ইচ্ছেও হয় না |

সামনে দাড়িয়ে থাকা তাশফিকে দেখে একটু ঘাবড়ে অর্নব বলল,শাড়িটা এখনো পড়ে আছো?

- হুম কেন,খুব বেশি সুন্দর লাগছে?

- তোমার আব্বু কোথায়?

- আব্বু আসবে কোথ্থেকে,আব্বু তো বিদেশ |

- ওহ সরি,ভুল হয়ে গেছে | ইয়ে মানে আম্মু...

- আমার বড়খালা আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে তো তাই অফিস শেষে আম্মু তার বাসায় গেছে | আজ রাতে ফিরবে না বলেছে |

- তারমানে পুরা বাড়িতে তুমি একা?

- হুম | না না,কাজের মেয়েটা আছে তো |

- ভালই হয়েছে,বেশি লজ্জা পেতে হবে না |

- বিড়বিড় করে কি বলছেন স্যার?

- তাশফি আমি দু'প্লেট ভাত খাব | বাসায় আম্মা নেই তো তাই খেতে পারিনি....আর আমার ঐ বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি তালা মারা | কোথায় গেছে কে জানে | দিতে পারবে,খুব খিদে লেগেছে জানো |

- এক্ষুনি আনছি |

এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে পড়ল তাশফি | আর এক সেকেন্ড ওখানে থাকলে,স্যার চোখের পানি দেখে ফেলত | একটা মানুষ এত সরল হয় কি করে?

অতিরিক্ত মায়ায় পড়লেও যে চোখে পানি এসে ভরে যায়,তা আজ প্রথম জানলো মেয়েটা |


রাস্তাটা এখনি কেমন খালি হয়ে গেছে | মানুষজন তেমন একটা নেই,আর কয়েকটা রিকশার এদিক ওদিক ছুটে চলা |

পিচঢালা পথটায় মানুষ,রিকশা সবকিছুর ছায়া পড়ছে | জোছনা দিয়ে গড়া একেকটা ছায়া | আকাশে যে আজ বিশাল একটা চাদঁ,তাইতো এত জোছনা !


সেসব ছায়ার উপর নিশ্চুপ হেটে চলেছে একটা বোকাসোকা চেহারার ছেলে | ছেলেটানা একটু একটু করে ঘামছে | কারণ পাশে থাকা শাড়ি পড়া মেয়েটা তার একটা হাত শক্ত মুঠোতে ধরে আছে | যে মুঠো থেকেই ডানা ঝাপটাচ্ছে শুভ্র এক মায়াপাখি