বাংলা চলচ্চিত্রের “অস্তিত্ব” রক্ষার লড়াই!!

মুভি রিভিউ August 9, 2016 2,597
বাংলা চলচ্চিত্রের “অস্তিত্ব” রক্ষার লড়াই!!

“অস্তিত্ব” / The Existence


প্রারম্ভিক কথাঃ সম্প্রতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের অটিজম নিয়ে একটা লেখা পড়ে প্রতিবন্ধীরা যে বিশেষ কিছু গুনের অধিকারী তা জানা যায়। তাদের মধ্যে কেউ খুব সহজে অংকের সমাধান করতে পারে, কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউবা ভালো গান গাইতে পারে। এই ছবির ট্রেইলার দেখে ও প্রিভিউ পড়ে আভাস পাওয়া গিয়েছিল এদের নিয়ে কিছু একটা করতে যাচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প। যদিও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে “পা”, ”বারফি”র মত কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আমাদের দেশে এই ধরনের চলচ্চিত্র এবারই প্রথম (আরও দুইটা আসছে)।




প্রধান অভিনেতা – অভিনেত্রী পরিচিতি



(Arefin Shuvo)


আরিফিন শুভঃ(Arefin Shuvo) মডেলিং দিয়ে যাত্রা শুরু করে পরবর্তীতে টিভি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। পরবর্তীতে সিনেমার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে চলচ্চিত্রে আগমন করেন এবং শীর্ষ নায়কদের একজন হিসেবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেন। আরিফিন শুভর শুরু হয়েছিল মডেলিং এর মাধ্যমে। ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত হ্যা/না নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় তার যাত্রা শুরু। ২০০৮ সালে ইজ ইকুয়াল টু ধারাবাহিকে অভিনয় করে তিনি নিজের অবস্থান আরেকটু পোক্ত করেন। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জাগো সিনেমায় অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য এর পরে তিনি বেশ কিছুদিন চলচ্চিত্র থেকে দূরে ছিলেন। এ সময় তিনি ছোটপর্দায় অভিনয় করেন এবং নিজেকে চলচ্চিত্রের জন্য প্রস্তুত করেন। অবশেষে ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি পুনরায় চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন।


নুসরাত ইমরোজ তিশা


2. নুসরাত ইমরোজ তিশাঃ ১৯৯৫ সালে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পাওয়া নুসরাত ইমরোজ তিশা’র মিডিয়া জগতে পদার্পণ টেলিভিশনের মাধ্যমেই। শিশুশিল্পী হিসেবে মূলত গান করতেন। তবে অনন্ত হীরার “সাতপেড়ে কাব্য’ নামে একটি নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে শখের বশে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে তার পদচারণার শুরু। এরপর তরতর করে এগিয়ে গিয়েছেন সামনে। ২০০৩ সাল থেকে অভিনয় ও মডেলিংএ পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৩ সালে অ্যাঞ্জেল ফোর নামে একটি ব্যান্ডদল গঠন করেছিলেন তিশা, কণা, রুমানা ও নাফিজা। এর মধ্যে নাফিজা মৃত্যুর ওপারে চলে গেছেন। গান নিয়ে ব্যস্ত আছে কণা। আর চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছেন রুমানা। যদিও রুমানা এখন অভিনয়ে নিয়মিত নন। অন্যদিকে গানে অনিয়মিত তিশা তার অভিনয়কে পুঁজি করেই চলছেন। সংসার জীবনে তিশা ২০১০ সালে টিভি ও চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।


গল্পঃ বিশেষ এইসব শিশুদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও মানসিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে তুলে ধরা হয়েছে অস্তিত্ব চলচ্চিত্রে। প্রথমেই দেখা যায় পরী নামে একটি মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে তার ছোট ভাইয়ের সাথে খুনসুটি করে আর বাবা-মায়ের কাছে খুবই আদরে যত্নে বড় হচ্ছে। তার দৈহিক বৃদ্ধি হলেও মানসিক বৃদ্ধি হয় না। তার ছোট ভাইয়ের বান্ধবী জারার সাথে তার পরিচয় হলে জারা তার ভাই ও বাবা-মাকে বিশেষ স্কুলের কথা জানায়। তার বাবা-ভাইয়ের আগ্রহ থাকলেও তার মা তাকে যেতে দিতে চান না। শেষপর্যন্ত তাকে পাঠানো হয় সেই বিশেষ স্কুলে। সেখানে সে অন্য শিশুদের সাথে মিশে এবং স্কুলের শিক্ষক ইমতু ও অন্যদের তার প্রতি ব্যবহারে সে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠতে থাকে। কিন্তু এরই মধ্যে এক দুর্ঘটনা পরীসহ সকল শিশুদের অস্তিত্ব রক্ষা ও মানসিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে।


ভালো দিকঃ অস্তিত্ব সিনেমাটির প্রাণ ছিল এর কেন্দ্রীয় চরিত্র নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয়। অটিস্টিক চরিত্রে তার অভিনয় ছিল অনবদ্য। তার মুখে আধ-আধো কথা আর মুখের ভাবভঙ্গি ছিল চমৎকার। আর আরেফিন শুভর একের পর সিনেমাতে অভিনয়ের উন্নতি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কতটা পরিশ্রম করছে। বিশেষ শিশুদের সাথে একজন শিক্ষক যেরকম হাসিমুখে কথা বলে সেরকম মুচকি হাসতে হাসতে ডনের সাথে দেখা করতে যাওয়া এটা ছিল তার ফার্স্ট লুক। আর পুরো সিনেমা জুড়ে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তার অভিনয় ও অটিস্টিক শিশুদের তাদের মত করে বোঝানোর প্রবণতাটা প্রশংসার দাবিদার।


সিনেমাটির আরেকটি বিশেষ দিক ছিল শ্রুতিমধুর কিছু গান। “আয়না বলনা” গানটি ইউটিউবে ছাড়ার পর গানটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে এই গানে ক্যামেরার কাজ ও লোকেশনের জন্য। “আমি বাংলার হিরো” গানে তিশার নাচ দেখে অভিভূত। তিশাকে এতো গ্লামারাস রুপে এই প্রথম দেখলাম।


পরিচালক অনন্য মামুন ও তার দল, শুভ, তিশা সিনেমাটির প্রচারনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর কালবৈশাখীকে উপেক্ষা করে সকলের কাছে সিনেমাটি প্রচার করা প্রয়াস ছিল অনন্য।


মন্দ দিকঃ অন্যদিকে, দর্শক এখন আগের থেকে অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। তাই যাচ্ছেতাই তারা এখন আর গ্রহণ করছে না এই বোধটা চলচ্চিত্রকারদের আসা দরকার।


অপ্রয়োজনীয় ও হাস্যকর ভিএফএক্স দর্শক এখন সহজে ধরতে পারে। সিনেমাতে স্পেশাল অলিম্পিকের বাছাইয়ের আগে ট্রেনিং-এ যাওয়ার সময়টাতে মনে হচ্ছিল ৬০-৭০ এর দশকের কোনো সিনেমা দেখছি। এটা দৃষ্টিকটু লেগেছে। সুচরিতা ও ডনের মত অভিনয়শিল্পীরা তাদের স্বরুপে ছিলেন না। তাদের অভিনয় চেঁচানো ও ওভারআক্টিং লেগেছে ২-১টা সিন বাদে। গল্পটা ভালো হলেও গল্পের শেষটুকু আশানুরুপ হয়নি। প্রথম অর্ধেক দেখার পর ভাবছিলাম ভালো একটা শেষ কি দেখতে পাবো! এবং তাই হল। পুরো সময় দেখার পর মনে হল লেখকের বিশেষ শিশুদের নিয়ে ভালো একটা কিছু মাথায় এসেছিল। সে তাই লিপিবদ্ধ করেছে কিন্তু শেষটার কথা ভাবেনি। পরিচালনায় কিছু খুঁত থাকলেও তিশা–শুভর অভিনয় তা উতরে গেছে।


শেষ কথাঃ সিনেমাটি ৬ মে, ২০১৬ বাংলাদেশে ও ২৭ মে কানাডায় মুক্তি পায় । যাই হোক, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প এখনো সব বাঁধা কাটিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারলেও এ ধরনের কাজগুলো চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আটিজম নিয়ে আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও গল্পের ইমতুর মত এগিয়ে আসতে হবে তবেই আমরাও মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত বলতে পারব ‘যদি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিতেই হয় তাহলে তুমি বাংলাদেশে জন্ম নাও। কারণ, এ দেশটি সব রকম প্রতিবন্ধী মানুষকে বুক আগলে রক্ষা করে’।