মুভি রিভিউঃ কৃষ্ণপক্ষ মন্দ ছবির ভিড়ে একটি মন্দের ভালো ছবি

মুভি রিভিউ July 30, 2016 2,140
মুভি রিভিউঃ কৃষ্ণপক্ষ মন্দ ছবির ভিড়ে একটি মন্দের ভালো ছবি

— কুসুম নামের গ্রাম্য চপলা এক কিশোরী। অভাব অনটনের মন্দেও চপল, সরল জীবন তার। গান ভালোবাসে; আর ভালোবাসে তার মতি ভাইকে। প্রথম ভালোবাসার অদম্য আবেগ বুকের মধ্যে চেপে রাখে সে। আর যেদিন কুসুমের বিয়ে ঠিক হয় অন্য একজনের সঙ্গে, সেদিন তার সেই দীর্ঘ্য চাপা আবেগ তার প্রানটাকেই গ্রাস করে; একেবারেই চুপিসারে। প্রখ্যাত নির্মাতা, লেখক হুমায়ুন আহমেদের শ্রাবন মেঘের দিন ছবিটির কথা বলছিলাম। শ্রাবন মেঘের দিন ছবির সেই শেষ দৃশ্যটি; অর্থাৎ যখন কুসুমের লাশ কাঁধে করে তার মা চিৎকার করে বলে ”বিষ খাইছে গো” … কিংবা শেষের মতি ভাইয়ের সেই গান ” শোয়া চাঁন পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছোনাকি ”; চলচ্চিত্রের পর্দায় এমন আবেগীয় সুন্দর দৃশ্য শুধু আমাদের দেশে না বরং বিশ্ব চলচ্চিত্রে বিরল। অথচ হুমায়ুন স্যারের কাছে না ছিলো টেকনোলোজি, না ছিলো বাজেট। শুধুমাত্র শ্রাবন মেঘের দিন না বরং হুমায়ূন আহমেদ- এর সবগুলো চলচ্চিত্রে আমরা দেখি অসাধারন সরল সব চরিত্র আর সরল আবেগের অসম্ভব রকম সুন্দর সব সংলাপ এবং সবমিলিয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়ার সব দৃশ্যের সমন্নয়ে সুন্দর ছবি।



কৃষ্ণপক্ষ ছবিতে রিয়াজ এবং মাহি


কৃষ্ণপক্ষের রিভিউতে শ্রাবন মেঘের দিনকে নিয়ে আসার নানা কারন রয়েছে বটে।


প্রথমত, কৃষ্ণপক্ষ সবার প্রিয় কথাসাহিত্যিক, শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন স্যারেরই আরেকটি আবেগীয় উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ। দ্বিতীয়ত, ছবিটির নির্মাতা কেবলমাত্র একজন নবীন চলচ্চিত্রকারই না, বরং তিনি হুমায়ুন স্যারের ভালোবাসার মানুষ, তার স্ত্রী; যার সাথে তার নানাভাবেই পরম আবেগের সম্পর্ক। আর তিনিই সেই, যিনি শ্রাবন মেঘের দিনের সেই কুসুম; যাকে অভিনেত্রী হিসেবে ব্যাক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি।


সূতারং, বলাই বাহুল্য এই যে, কৃষ্ণপক্ষ ছবিটির কাছে চাওয়ার ছিলো শুধুই আবেগ। রুপালী পর্দায় ফুটে ওঠা সুন্দর, শৈল্পিক আবেগ।


শাওনের কাছে পর্দায় সেই শৈল্পিক আবেগ সৃষ্টির সবই ছিলো। আবেগময় সুন্দর গল্প, চরিত্র এবং ব্যাক্তিগতভাবে তার নিজের বুক ভরা আবেগ। তিনি কি পর্দায় সে আবেগ ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন ?


কৃষ্ণপক্ষে নির্মাতা হিসেবে শাওনের চেষ্টা চোখে পড়েছে। হুমায়ূন স্যারের ছায়া হয়ে নয়, বরং তাকে অনুপ্রেরনা হিসেবে রেখে শাওন তার নির্মানে নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরির চেষ্টা করেছেন; যেটি প্রশংসনীয়। তবে অভিনেতাদের সংলাপ বলার ধরনটি কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই হুমায়ূন আহমেদীয় স্টাইলকে মনে করে দিয়েছে এবং দর্শক হিসেবে এটি ছিলো আমার অভিযোগের একটি জায়গা।


কৃষ্ণপক্ষে শাওন ”অরূ মুহিবের” ভালোবাসার সম্পর্কের চেয়েও গুরুপ্ত দিয়েছেন মুহিব এবং তার বোনের আবেগীয় সম্পর্ককে এবং সেটি এক হিসেবে খুবই ভালো একটি দিক। নির্মাতা যে উপন্যাসকে হুবহু ফলো না করে তার নিজস্ব কিছু চলচ্চিত্রে নিয়ে আসতে পেরেছেন তার প্রশংসা না করলেই নয়। কিন্তু তারপরও শাওনের কৃষ্ণপক্ষে অরূ-মুহিবের কেমিস্ট্রি একেবারেই আসেনি। এমনকি মুহিব এবং তার বোনের আবেগের সম্পর্কটিও কেন যেন হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। কোথায় যেন গন্ডগোল ছিলো। বরং ছোট ছোট চরিত্রগুলো, যেমন অরূর বোন, মুহিবের বন্ধু পত্নী, মুহিবের গাড়ীর সেই যাত্রী পরিবার, ড্রাইভার; এমনকি ছোট বেলার মুহিব, তার বোন, আবরার সাহেব; সবাই যেন অনেক বেশী জীবন্ত ও উপভোগ্য।


প্রধান চরিত্রগুলো হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি বলেই কৃষ্ণপক্ষ সম্ভাবনা থাকার পরও অসাধারন কোন সৃষ্টি হতে পারেনি। সমস্যা ছিলো চিত্রনাট্যে, সমস্যা ছিলো কাষ্টিং-এ।



রিয়াজ এবং মাহি


চিত্রনাট্যে প্রধান চরিত্রগুলো অনেক তাড়াহুড়োভাবে চলে। মুহিব, অরূ যে স্থিরতা দাবী করে তা চিত্রনাট্যে নেই। আর কাষ্টিং-এ ২৬ বছরের সরল মনা অসাধারন মুহিব কখনোই চল্লিশোর্ধ রিয়াজের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করতে পারে না। রিয়াজ অত্যন্ত ভালো অভিনেতা তাতে কোন সন্দেহ্‌ নেই। এ ধরনের চরিত্র রিয়াজের অভিনেতাই দাবী করে তাও ঠিক। কিন্তু ২০ বছরের আগের রিয়াজ আর আজকের রিয়াজ কোন অবস্থাতেই এক হতে পারে না। বিশেষ করে মুহিবের মতো চরিত্রে আজকের রিয়াজ একেবারেই বাস্তবস্মমত না। মাহিয়া মাহি অন্যদিকে মোটামুটির মানের অভিনেত্রী হয়েও এ ছবিতে ভালোই অভিনয় করেছেন। এ ছবিতে তাকে অনেকটাই ম্যাচিউর মনে হয়েছে। মাহির অভিনয়ে ত্রুটি না থাওলেও অরূ চরিত্রে যেন আরো কোমল, আরো ন্যাচারাল কাউকে চাই।


অভিনয়ের দিক থেকে বেশী ন্যাচারাল ছিলো সাপোর্টিং কাষ্ট- এর অনেকে। অরূর বোনের চরিত্রে মৌটুসি বিশ্বাস, মুহিবের বন্ধু পত্নী চরিত্রের অভিনয় শিল্পী, ছোটবেলার মুহিব, তার বোন, এমনকি তানিয়া আহমেদ এবং আজাদ আবুল কালামও ভালো ছিলেন।


ছবির গানগুলো ছবিকে সাপোর্ট করতে পারেনি। বিশেষ করে রিয়াজ কাষ্টিং-এ এপিক ফেইল হওয়ার কারনেই তার অভিনীত গানও এপিক ফেইল ছিলো। অন্যথায় হুমায়ূন আহমেদের কথা গানে শুনতে ভালোই লাগার কথা।


সম্পাদনা এবং চিত্রধারন খুব আহামরী না হলেও চলনসই ছিলো।




সবমিলিয়ে, চলচ্চিত্রে শাওনের প্রথম চেষ্টা আহামরী কিছু না হলেও একেবারে খারাপও হয়নি। নির্মাতা হিসেবে শাওনের সৎ চেষ্টা চোখে পড়েছে। তবে সাধারন মানের চিত্রনাট্য এবং বেমানান কাষ্ট ছবিটিকে হুমায়ূন আহমেদের গল্প বা চরিত্রের যে আবেগ বা যাদু তা দিতে পারেনি। বস্তাপঁচা ছবির ভিড়ে মন্দের ভালো এ ছবিটি হতে পারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত হলে বসে ভালো সময় কাটানোর একটি ভালো অপশন।


আমি ছবিটিকে ১০ এ ৬ দিবো (3/5*)