“অস্তিত্ব (২০১৬)” – পরিপূর্ণ পর্যালোচনা ও ‘অস্তিত্ব’র অস্তিত্ব

মুভি রিভিউ July 30, 2016 1,101
“অস্তিত্ব (২০১৬)” – পরিপূর্ণ পর্যালোচনা ও ‘অস্তিত্ব’র অস্তিত্ব

অটিজমে আক্রান্তদেরকে অটিস্টিক বলা হয়। অটিষ্টিক শিশুদেরকে কেউ কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী বলে থাকেন। অটিজমে আক্রান্ত কোনো কোনো শিশু বা অটিষ্টিক শিশু কখনো কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শীতা প্রদর্শন করতে পারে। অটিস্টিক শিশুরা অনেক জ্ঞানী হয়। তবে আট দশটা শিশুর মত এদের জ্ঞান সব দিকে সমান থাকে না। এদের কারো থাকে গণিতের উপর অসাধারন জ্ঞান, কারো বিজ্ঞান, কেউ বা অসাধারন সব ছবি আঁকতে পারে, কারো আবার মুখস্ত বিদ্যা প্রচুর বেশি হয়। আর এ জন্য কোন অটিস্টিক শিশুকে ঠিক মত পরিচর্চা করলে হয়ে উঠতে পারে একজন মহা বিজ্ঞানী। এদের কথা বলার কারণ হচ্ছে, হয়তো আপনার পাশের অস্বাভাবিক ছোট বাচ্চাটি অটিজমে আক্রান্ত। তাকে সাহায্য করুন বেড়ে উঠায়। সে ও হতে পারে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। এমনকি আপনি ও হয়তো একজন অটিস্টিক। অটিস্টিকরা ও সমাজের একজন তারাও হতে পারে অনেক বড় কিছু, পেতে পারে অনেক বড় সাফল্য এই ম্যাসেজ নিয়ে গড়ে উঠে “অস্তিত্ব” মুভিটি। মুভিতে অটিস্টিক চরিত্রের ভূমিকাতে অভিনয় করেন তিশা এবং অটিস্টিক স্কুলের শিক্ষকের চরিত্রে আরিফিন শুভ।


বাংলা চলচিত্র অগ্রসর হচ্ছে, প্রতিটি চলচিত্র থেকে আমরা কিছু না কিছু গ্রহণ করছি। বস্তাপচা নকল মুভি অথবা কাটপিসের দিনগুলোতে বাংলা চলচিত্র যেভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো তার থেকে একটু একটু করে আমরা মুক্তি পেতে চলেছি কিছু কিছু নির্মাতার মৌলিক মুভি নিয়ে চিন্তা ভাবনার জন্য। অনন্য মামুন-এর অস্তিত্ব একটি শুদ্ধ মৌলিক কাহিনী নির্ভর মুভি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আসলে আমাদের মুভির কাহিনী মৌলিক হবার সাথে সাথে তার মেকিং, কাহিনীর গভীরতা এবং দৃশ্যায়নেও উন্নত করতে হবে। কারণ উল্লেখিত একটি উপাদান ব্যতীত পুরো মুভিটি পরিপূর্ণ প্যাকেজে পরিণত হতে পারে না। মুভির টেকনিক্যাল এবং কলাকুশলী গত পারফরম্যান্স এর দিকে আলোকপাত করা যাক।


▬▬▬▬▬▬▬★মুভির শক্তিশালী দিক সমূহ★▬▬▬▬▬▬▬▬


➔ মুভির সব থেকে শক্তিশালী দিক হচ্ছে আরিফিন শুভ এবং তিশার অভিনয়। আরিফিন শুভ’ র অভিনয় এক কথায় অনবদ্য। একজন অভিনেতা কতটা ডেডিকেটেড হলে এতো চমৎকার অভিনয় করতে পারেন তা শুভকে দেখে শেখা উচিত। একই সাথে একজন সাধারন মানুষ এবং একই সাথে অটিস্টিক বাচ্চাদের সাথে তাদের মত করে তাদের বোঝানো, এক কথায় অসাধারণ। মুভির শেষ দৃশ্যতে শুভর এক্সপ্রেশন দেখে আনন্দ অশ্রুর সালমান শাহ এর সেই পাগলাটে শান্ত মুখের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। যদিও সালমান শাহ এর মত হয়নি। কিন্তু অনেকদিন পর কেউ এমন দারুণ এক্সপ্রেশন দিল। (শুভ, সালমান শাহ নিয়ে ক্যাচাল করবেন না)।


তিশা বর্তমানে সব থেকে শক্তিশালী অভিনেত্রী। অভিনয়ে মাঝে মাঝে সে নিজেকে ছাড়িয়ে যায়। অটিস্টিক চরিত্রে তার অভিনয় ছিল দারুণ। ইমতু ইমতু বলে ডাক ছিলো বেশ শ্রুতিমধুর। মুভিতে তার এক্সপ্রেশন যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই রকম ছিলো, তাও অটিস্টিক চরিত্রে এর থেকে বেশি ভ্যারিয়েশন খুব একটা হয় না। (কেও বারফি মুভির সাথে ত্যানা প্যাচাতে আসবেনা না, আপনার থেকে আমার বেশি জানা আছে বারফিতে কার অভিনয় কেমন ছিলো, আর কে কোথা থেকে কি করে কপি করেছে) । এমন অভিনয় তিশা ছাড়া আমাদের এখানে করার মত এখন কেউ নেই। কাল সকালে মুভিতে শাবনূরের অভিনয় দেখে একবার অভিভূত হয়েছিলাম আর এবার তিশাকে দেখে হলাম। আশা করছি সে বড় পর্দাতে নিয়মিত হবে।




➔ মুভির দ্বিতীয় শক্তিশালী দিক হল, মুভির থিম। বেশ ভালো থিম ছিলো।


➔ মুভির তৃতীয় শক্তিশালী দিক হল শ্রুতিমধুর গান। “আয়না বল না”, “তোর নামে লিখেছি হৃদয়” গান দুটি বেশি ভালো ছিলো।


➔ মুভির প্রচারণাতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে অস্তিত্ব। দেখিয়েছে সবার কাছে কি করে পৌছে দিতে হয় একটি মুভির নামকে। সে দিক থেকে অনন্য মামুন, শুভ, তিশা এবং পুরো অস্তিত্ব টিমকে ধন্যবাদ।


➔ মুভির সর্বশেষ ভালো দিক হল গানের দৃশ্যায়ণ এবং ক্যামেরার কাজ। বেশ ভালো ছিলো গানের দৃশ্যায়ণ, আয়না বল না গানে ক্যামেরার কাজ এবং শেষে দৃশ্য দেখে আসলেই মুগ্ধ হয়েছি।




তবে অভিনয়, থিম, গান সবকিছু ভাল হলেও মুভির কিছু কিছু দূর্বল দিক খুবই চোখে পরার মত। আসুন সেদিকেও একটু নজর দেওয়া যাক।


▬▬▬▬▬▬▬▬★মুভির দুর্বল দিক সমূহ★▬▬▬▬▬▬▬▬


➔ মুভির গল্প বা স্টোরি টেলিং ছিলো খুবই দূর্বল। অযাচিত ভাবে মুভির প্রথম অর্ধে গল্প টেনে নিয়ে গেয়েছেন। যা খুবই বোরিং ছিলো। জোভান ও তার প্রেমিকার ব্যপারটি এতো বেশি দেখানোর কি কারণ ছিলো সেটা আমার মাথায় আসে নি। অপ্রয়োজনীয় একটি গান ছিলো তাদের। এখানে এতো বেশি সময় না দিয়ে মুভির থিমটা কে বেশ করে ঘসামাজা করলে ভালো হত।


➔ দারুণ একটি থিমের উপর মুভিটি করা হয়েছে। বেছে নেওয়া হয়েছে অটিজমকে। কিন্তু মুভিতে শুধু দেখানো হয়েছে অটিস্টিক বাচ্চারাও ভালো কিছু করতে পারে। কিন্তু তাদের বেড়ে ওঠা এতোটা মসৃণ নয়। সমাজের প্রতিকূলতাকে বাধা দিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে হয়। মুভিতে তাদের প্রতি সমাজের বিরূপ আচরণ দেখানো হলে এবং কিভাবে সেটাকে উতরে আসা যায়, সেদিকে নজর দিলে একই সাথে দুটো ম্যাসেজ আমাদের সমাজের কাছে দেওয়া যেতো।


➔ অপ্রয়োজনীয় ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ভিএফএক্স কে। কোন দরকার ছিলো না ড্রাম উড়ে যাবার দৃশ্য দেখানো। এছাড়া তিশাদের ট্রেনিং এর জন্য কক্সবাজার যাবার সময় গাড়ির দৃশ্যটাতে কেন ভিএফএক্স ইউজ করল আমি ঠিক বুঝলাম না। মনে হচ্ছিল আমরা ৬০ দশকে ফিরে গেছি। একটা লং এবং একটা ক্লোজ শটেই যে দৃশ্যটি শেষ করা যেতো সেটিকে পুরোপুরি হাস্যকর বানিয়ে ফেললেন। কোন দরকার ছিলো না ।


➔ মুভির গান গুলো ঠিকঠাক মত ব্যবহার করা হয়নি। আয়না বল না গানটি কি করে ঐ সময় ব্যবহার করলেন বুঝলাম না। মনে হল একটি গান দিয়ে ইন্টারভ্যাল দেওয়া প্রয়োজন, তাই জোর করে ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর “আমি বাংলার হিরো” গানটিতে একই কাজ করলেন, ভালো কথা মুভির এমন এন্ডিং এর পর আইটেম সং ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু তাই বলে শুভ তিশার আসল নাম ব্যবহার করে মুভির মাঝে এই গান ঢুকিয়ে দিলেন, যেখানে ডন নিজেই বলেছে সে ইমতু কে দেখে চারাপাশে। তাহলে তাদের আসল নাম কেন ব্যবহার করলেন? এইগানটি আপনার উচিত ছিলো মুভির প্রথমে ব্যবহার করা।


➔ ডনের মত একজন শক্তিশালী অভিনেতাকে এই মুভিতে ঠিক মত ব্যবহার করতে পারে নি। তার মাতলামি গুলো যে ওভার এক্টিং ছিলো সেটি অভিনয় দেখলেই বোঝা গেছে। মুভি দেখার সময় ডনের শেষ দৃশ্যেতে তার অভিনয় ছাড়া পুরো মুভিতে এই শক্তিমান অভিনেতার অভিনয় দেখে আমি হতাশ। আচ্ছা অভিনেতা তো চাইলে নিজ থেকেও তার সেরাটি দিতে পারে ।


➔মুভির এডিং দেখার পর যে কোন সাধারণ মানুষের মনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর প্রশ্ন চলে আসবে। এইটা আসলেই ঠিক হয়নি।

————————————————————————


মুভির ২য় অর্ধ মুভিটিকে কিছুটি গতি প্রদান করলেও তা প্রথম অর্ধের রেশ কাটিয়ে তুলতে পারে নি। আমাদের দেশে এমন ধরণের মুভি হয় না। এমন থিমের উপর কাজ করার জন্য আসলেই বাহবা পাবার যোগ্য “অস্তিত্ব” টিমের। সবদিক বিবেচনা করলে মুভিটি শুধুমাত্র তার স্টোরিং টেলিং এবং প্রপার প্লেসমেন্ট এর জন্য পিছিয়ে পড়ল। তারপরও মুভিটির সব থেকে পজেটিভ দিক হল পরিবার নিয়ে দেখার মত, সকল দর্শকের জন্য নির্মিত একটি মুভি।




সবদিক বিবেচনা করলে আমি আমার দিক হতে মুভিটিকে রেটিং দিবো ৬/১০। আশা করি অনন্য মামুন এই ত্রুটিগুলো তার পরবর্তী মুভিতে শুধরে আমাদের আরো ভালো মুভি উপহার দিবেন।


ধন্যবাদ