শঙ্খচিল (২০১৬) – এক জাতি ও দুটি দেশের কাহিনী

মুভি রিভিউ July 21, 2016 2,530
শঙ্খচিল (২০১৬) – এক জাতি ও দুটি দেশের কাহিনী

“আবার আসিব ফিরে

ধানসিঁড়িটির তীরে

এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়

হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে “


ঠিক এইভাবেই শেষ হয় শঙ্খচিল মুভিটি। আর মুভির যেখানে শেষ ঠিক সেখান থেকেই আমি আমার লেখাটি শুরু করলাম। কারণ মুভি দেখার সময় যা লিখব বলে ভেবেছিলাম মুভি দেখার পর চিন্তাটি পালটে গেল। আমার লেখাটি কোন রিভিউ না, লেখাটি আমার অনুভূতি, আবেগ ও বিবেকের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মুভি শেষ করে শুধু মনে হচ্ছিল বেলাশেষের মত একটি অনুভূতি পেলাম।


প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য। আমাদের দেশ থেকেও মানুষ চিকিৎসার জন্য যায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেটা হয় বৈধ কিংবা হয়ে থাকে অবৈধ উপায়ে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে জটিলতা ও দীর্ঘসময়ের জন্য অনেকেই জীবনের ঝুকি নিয়ে অবৈধ পথে ঢুকে পরে ভারতে।




ঠিক এমনই ভাবে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের স্কুল মাস্টার মুনতাসির চৌধুরি বাদল তার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসে নদী পার হয়ে ভারতে। এই হল মুভির আসল কাহিনী, কিন্তু এই ছোট কাহিনীর আড়ালে দেখানো হয়েছে জাতিগত দ্বন্দ, একটি জাতির বিভাজন এবং মানুষের বিবেকহীনতার।


১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পটভূমি নিয়ে গড়ে ওঠা এ মুভিতে দেখানো হয়েছে, ১৯৪৭ সালে শুধু দুটি দেশের সৃষ্টি হয়নি হয়েছে বাংগালি জাতির মৃত্যু। কারণ তখনের দেশ বিভাজন যদি ভালো করে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে যে একই ভাষার একটি বিশাল জনগোষ্টীকে একটি লাইনের মাঝে ফেলে দু ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। তাল গাছের গোড়া যদি থাকে বাংলাদেশে দেখা যাবে সেগাছ বড় হয়ে বেকে যাবার ফলে তাল পড়বে ভারতে। আবার একই লোকের বাসা যার শয়ন কক্ষ বাংলাদেশে আর হেসেলঘর (রান্নাঘর) ভারতে। বড়ই আজব এক বিভাজন। জনাব ছাগলের শূন্য নম্বর বাচ্চার তিন নম্বর ছেলে লালবন্ধনী ইংলিশে যাকে বলা হয় গাধা রেডক্লিফ, তিনি এই ঝামেলা এবং ত্রুটিপূর্ণ বিভাজন করেছিল মাত্র ১ মাসে।




১৯৪৭ বা বঙ্গভঙ্গ,১৯৪৭ বাংলার রাজনৈতিক ভূগোলে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন । এর ফলে বঙ্গ প্রদেশ দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পরে যার পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানে এবং পশ্চিমাঞ্চল ভারতের সাথে যুক্ত হয় । ইতিহাসের বিচারে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছিল এই ভূখণ্ডের সেই অঞ্চলগুলোর যেই অঞ্চলগুলো বিভেদরেখার প্রান্তীয় ভৌগলিকতার কারণে জাতিগত ভাবে দ্বিখণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ।




মুভিতে খুব সুন্দর করে দেখানো হয়েছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো বিভাজিত হবার ফলে একই পরিবারের লোকজন আলাদা হয়ে যায়। তাদের বিবাহ পার্বনে কেও কারো কাছে যেতে পারে না। ভালোবাসা আন্তীয়ের সম্পর্কের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটি কাঁটাতারের বেড়। যা শঙ্খচিল খুব সহজেই অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু শ্রেষ্ঠজীব মানুষ যেখানে অপারগ।


সীমান্তে ভালবাসা আবেগের কোন মুল্য নেই সেখানে দায়িত্বের কাছে হার মেনে যায় ভালোবাসা। কারণ ভালোবাসা থেকে একটি কাঁটাতার অনেক বড়।


গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল আক্ষরিক অর্থেই যৌথ প্রযোজনার ছবি। মুভির ১ম অর্ধ ছিলো বাংলাদেশে আর বাকী অর্ধেক ছিলো ভারতে। অভিনেতার দিক থেকেও ছিলো সেটা। বাংলাদেশের সাঁঝবাতি বলতে গেলে একাই কাপিয়েছে মুভিটিতে। তার সরল চঞ্চল চপলা স্বভাব, মিষ্টি হাসি আর দুষ্টুমি কেড়ে নিয়েছে সবার মন। একই সাথে প্রসেনজিৎ এগিয়েছে সমান তালে। দারুণ অভিনয় করেছেন সবাই। সাথে ছিল অনবদ্য স্ক্রীন প্লে, নদীর দৃশ্য ও খোলা হাওয়া। মেঘলা আকাশের সাথে নদীর পাড়ে বাতাসের সাথে পানির অপরূপ দোলা দেখলে আপনার মনে হবে এক্ষুনি গিয়ে বসে থাকি সেখানে, বাতাসের ঘ্রাণ ও বুকভরা নিঃশ্বাস নেবার জন্য।


আমার কাছে শঙ্খচিল শুধু একটি মুভি না, মনে হয়েছে দুই দেশের প্রাধানদের যদি মুভিটি দেখানো যেতো তাহলে হয়তো তারাও ভাবত ইউরোপের মত কিছু করার, রাখতো না এতো জটিলতা, কাঁটাতারের বেড়া।




শঙ্খচিল ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা প্রসেনজিৎ ও বাংলাদেশের কুসুম শিকদার। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও যেসব শিল্পী থাকছেন ছবিতে, অনুম রহমান খান সাঁঝবাতি, মামুনুর রশীদ, প্রবীর মিত্র, রোজী সেলিম, শাহেদ আলী, রিয়াজ মাহমুদ, প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি, দীপঙ্কর দে,উষসি চক্রবর্তী সহ অনেকে।সায়ন্তনী পুততুন্ড লিখেছেন ছবির চিত্রনাট্য।বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘শঙ্খচিল’ ভারতের ৬৩তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা ছবির পুরস্কার জিতেছে।


অসাধারণ এক মুভি শঙ্খচিল, না দেখলে আসলেই মিস করবেন। সব থেকে বেশি মিস করবেন সাঁঝবাতির মিষ্টি অভিনয়। মাই রেটিং ৯/১০