রোজার ঐতিহাসিক পটভূমি!

ইসলামিক ঘটনা June 26, 2016 4,822
রোজার ঐতিহাসিক পটভূমি!

রোযা ইসলামের গুরুত্বপূর্ন স্তম্ভ। রোযা আত্মিক ও আধ্যাত্বিক ইবাদত। আল কুরআনে আল্লাহ্ পাক ঘোষনা করেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মোত্তাকী হতে পারো।”(-সুরা বাকারা-১৮৩)


আল্লাহ বলেন, রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দান করবো, কারণ বান্দা আমার জন্য তার প্রবৃত্তিকে দমন করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।


রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মৃঘনাভীর সুগন্ধ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর এবং রোযা ঢাল ¯^রূপ। যখন রমযান মাস আসে তখন জান্নাতের দুয়ারগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দুয়ারগুলো বন্ধ করা হয় আর শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়।”(বুখারী)


রোজার ঐতিহাসিক পটভূমিঃ-আল কুরআন থেকে জানা যায়, আমাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের প্রতিও রোযা ফরজ করা হয়েছিল। আদি পিতা হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা(আ) পর্যন্ত সকল নবীদের উম্মতের উপর রোযা ছিল ফরজ ইবাদত। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের রোযার সময় ও সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। আগেকার যুগে রাতে নিদ্রা যাওয়া থেকেই রোযা শুরু হয়ে যেত। ইফতারের পর থেকে শয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্তই শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসবকিছু হারাম হয়ে যেত।


আদি পিতা হযরত আদম(আ) থেকে হযরত নূহ্(আ) পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমান, প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখতেন।


ইহুদীরা রোযা রাখত ৪০ দিন, খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা রোযা রাখত ৫০ দিন। আর হযরত মুহাম্মদ (স) এর উম্মতের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে ১ মাসের জন্য।


খ্রীষ্টানরা পরবর্তীকালে রোযা পরিবর্তন করে, ঘুরিয়ে দেয় দিনের সংখ্যা। (বায়হাকী শরীফ ও ফাত্হুল বার)


সর্বপ্রথম কোন্ রোযা ফরজ ছিল এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, আশুরার রোযা ফরজ ছিল, কারো কারো মতে প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা ফরজ ছিল। কেননা নবী করিম (সা) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন এ রোযাগুলো পালন করতেন।


হিযরতের দ্বিতীয় বছর শাবান মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুলআলামিন রোযার আদেশ নাযিল করেন। সে বছর অর্থাৎ হিজরী দ্বিতীয় বছর থেকেই উম্মতে মোহাম্মদের উপর রমযানের ৩০টি রোযা ফরয করা হয়।


আল্লাহ রাব্বুলআলামিন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, “রমযান মাস, এ মাসেই কোরআন নাযিল হয়েছে গোটা মানব জাতির জন্য হিদায়াত ও সত্য পথ প্রদর্শক, সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ন এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসেবে। অতএব তোমাদের মধ্যকার যে লোক এ মাস পাবে, সে যেন এ মাস ভরে সিয়াম পালন করে।” (সুরা বাকারা-১৮৫)


হযরত আদম (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত আদম(আ) ছিলেন আদি মানব। তিনি প্রথমে বেহেস্তেই থাকতেন। এক বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ) উভয়কে পৃথিবীতে পাঠানো হয়।


তারা প্রথম যেদিন পৃথিবীতে আসেন সে দিনটি ছিল মহরম মাসের ১০ তারিখ। পৃথিবীতে আসার এই দিনে কোন খাদ্য না পেয়ে আদম ও হাওয়া উভয়ে রোযার নিয়ত করে নেন।


সামান্য অপরাধের জন্য তারা সারে তিনশ বছর পর্যন্ত কেঁদেছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ই তাদের রোযা অবস্থায় কেটেছে। রাতে সামান্য খাওয়ার পর কিছু সময় ঘুমিয়ে নিয়ে আবার তাদের কান্না-বিলাপ অব্যাহত থাকতো।


এক সময় তাদের তওবা কবুলের পর আদম (আ) এর ঔরসজাত উম্মতের জন্য তাদের দুনিয়াতে আগমন ও তওবা মওকুফের দিনে শোকরিয়া স্বরূপ রোযা পালনের প্রথা চালু হয়।


হযরত ইব্রাহীম (আ) এর সময় রোযাঃ-মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর উপর সহিফা অবতীর্ণ হয় রমযান মাসের ১ তারিখে। সেদিনকে স্মরণে রাখার জন্য তার উম্মতের উপর রমযানের ১ তারিখের পাশাপাশি ২ ও ৩ রমযান সহ সর্বমোট ৩ দিন রোযা রাখা ফরজ ছিল।


তিনি যেদিন নমরুদের ভয়াবহ অগ্নিকুন্ড হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন সেই ঐতিহাসিক দিবসে রোযা রাখা তাঁর উম্মতের উপর ফরজ ছিল। তাছাড়া তিনি যেদিন তাঁর প্রাণ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেয়ার সংকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন এ দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওই দিবসের পূর্ববর্তী ৩দিন রোযা রাখা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর উম্মতের জন্য ফরজ ছিল।


হযরত ইব্রাহিম (আ) এর পরবর্তী নবী হযরত ইসমাঈল(আ) ও হযরত ইসহাক (আ) এর উম্মতের উপর রোযার এ ধারা অব্যাহত ছিল। হযরত ইসমাঈল (আ) এর উম্মতের উপর সর্বমোট ৭টি রোজা রাখা ফরজ ছিল বলে জানা যায়।


হযরত মুসা (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত মুসা(আ) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছে গাইডলাইন হিসেবে আসমানী কিতাব প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এ কিতাব পাওয়ার জন্য ১ মাস রোযা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি দীর্ঘ ১ মাস তুর পাহাড়ে গিয়ে রোযা পালন করতেন।


পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে আরো ১০ দিনসহ মোট ৪০ দিন রোযা রাখার পর হযরত মুসা(আ) এর উপর রমযান মাসের ৬ তারিখে পবিত্র তাওরাত কিতাব একত্রে নাযিল হয়।


হযরত মুসা(আ) ও হযরত হারুন (আ) এর উম্মতের উপর ১ মাস রোযা রাখা ফরজ ছিল। তবে আমাদের বর্তমান রোযার মত মুসা(আ) এর উম্মতের রোযার ধরণ এক রকম ছিল না।


ইহুদিদের প্রতি সপ্তাহের শনিবার, বৎসরের মহরমের ১০ তারিখে এবং মুসা (আ) এর তুর পাহাড়ে তাওরাত নাযিলের পূর্বে দীর্ঘ ৪০ দিন সিয়াম পালনের স্মৃতিস্মরণে ইহুদিদের প্রতি ৪০ দিন সিয়াম পালনের নির্দেশ আছে।


হযরত সোলায়মান (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত সোলায়মান (আ) আল্লাহর প্রতি কৃহজ্ঞতা স্বরূপ সারা বছরই রোযা রাখতেন। তাঁর উম্মতের উপর ৯টি রোযা ফরজ ছিল বলে জানা যায়।


হযরত নুহ (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত নূহ (আ) এর সময় খোদাদ্রোহী মানুষের উপর মহাপ্লাবন নামক গজব নাযিল হয়। সে প্লাবনের সময় সকল প্রাণী জীবের একেক জোড়া এবং ৪০ জন ঈমানদান মানুষকে বিশেষ নৌকায় আত্মরক্ষার জন্য স্থান দেয়া হয়।


দীর্ঘদিনের মহাপ্লাবনে সকল প্রাণীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে এই ৪০ দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হযর নূহ (আ) এর উম্মতের উপর ৪০ দিনের রোযা ফরজ করা হয়।


হযরত ইউনুস (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত ইউনুস (আ) দীর্ঘ ৪০ দিন মাছের পেটে অনাহারী অবস্থায় আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে ছিলেন। এই ৪০ দিন মাছের পেটে থেকে ইউনুছ (আ) রোযা রেখেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তাঁর উম্মতের উপর ৭টি রোযা ফরজ ছিল বলে জানা যায়।


হযরত দাউদ (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত দাউদ (আ) বছরের অর্ধেক সময় রোযা রাখতেন আর বাকী অর্ধেক সময় বিনা রোযাতে থাকতেন। হাদীসে এসেছে- মহানবী(সা) বলেছেন, “আল্লাহ রাব্বুলআলামিনের নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা দাউদ (আ) এর রোযা। তিনি এক দিন রোযা রাখতেন অন্যদিন বিনা রোযায় থাকতেন।” (বুখারী, মুসলিম)


হযরত ইউসুফ (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত ইউসুফ (আ) তার ১১ ভাইদের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অন্ধকার কুপে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ ৪০দিন পর্যন্ত তিনি অন্ধকার কুপের ভিতর আল্লাহকে ডাকতে থাকেন এবং এ সময় তিনি রোযা রেখেছিলেন। তাঁর উম্মতের উপর এই দুঃসহ-কঠিন দিনগুলিকে স্মরণ করার জন্য ৪০ দিন রোযা ফরজ ছিল।


হযরত ঈসা (আ) এর সময় রোযাঃ-হযরত ঈসা(আ) রোযা মুখেই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। রমযানের ১৮ তারিখে হযরত ঈসা(আ) এর উপর পবিত্র ইনজিল কিতাব নাযিল হয়। হযরত ঈসা নবী থাকা অবস্থায় শেষ নবী তথা আমাদের যুগের “হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম”-একটি মাত্র রজনী ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ ফযীলত জানতে পেরে ১৮ রমজান থেকে সেই মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত রোযা পালন করতেন।


এ রোযা তার উম্মতের উপরও ফরজ ছিল। হযরত ঈসা(আ) ইনজিল পাওয়ার পূর্বে দীর্ঘ ৪০ দিন সিয়াম পালন করেছিলেন।


জাহেলিয়াতের যুগে রোযা:-ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ জাহেলিয়াতের যুগেও রোযার প্রচলন ছিল।

“আশুরার দিনে কাবা শরীফে গিলাফ চড়ানো হতো; তাই আরবরা ঐ দিন রোযা রাখত।” (মুসনাদে আহমদ)


প্রাচীনকালে গ্রীকদের উপবাস পালনঃ-প্রাচীনকালে গ্রীকদের মধ্যে বছরের একটি বিশেষ মাসে ক্রমাগত ৭দিন ৭ রাত উপবাসের বিধান ছিল। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী উপবাস ছিল খুবই কষ্টকর এবং দুঃসহ।


বিভিন্ন জাতির উপবাস পালনঃ-পুরাকালে রোমান, কেল্ট, আসীরীয় ও বেবীলনীয়দের মাঝে উপবাসের বিধান চালু ছিল। জরথুস্থবাদী পারশিকগণ নানাবিধ উপবাস পালন করে থাকেন। কনফুসিয়াস বিভিন্ন রকমের উপবাসের প্রথা চালু করেন।


বৌদ্ধরাও বিভিন্ন ‘চীবর’ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে উপবাস পালন করেন। পারশিকগণ ১১দিন উপবাস পালন করে থাকেন।


কিন্তু অনেকে ৩৩ দিন আবার কেউ কেউ ৩দিন উপবাসব্রত পালন করে থাকেন। পারশিক ও ইহুদীদের কোন কোন উপবাসে পুরুষের পক্ষে নারীদের এবং নারীদে পক্ষে পুরুষদের সাক্ষাৎ মহাপাপ বলে মনে করা হয়।


বৌদ্ধদের অনেকসময় উপবাস অবস্থায় নির্জনবাসে থাকতে হয়। দিনের শেষে একবার মাত্র এক মুষ্ঠি ভিক্ষার সামগ্রী সিদ্ধ করে খেতে হয় বৌদ্ধদের।


ভারতীয় হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের উপবাসঃ-হিন্দুদের প্রতিটি পুঁজায় ব্রতী পুজারী ও অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নারী পুরুষ উপবাস পালন করে থাকেন। তারা ১ থেকে ৩দিন উপবাস ছাড়াও অমবস্যা ও পুর্নিমাতিথিতে উপবাস করে থাকেন। চান্দ্র মাসের ১১ ও ১২ তারিখে ব্রাহ্মনরা একাদশি ও দ্বাদশী উপবাস পালন করে থাকেন।


জৈন ধর্মের মধ্যে উপবাসের শর্তাবলী খুবই কঠোর। তাদের হিসাব মতে ৪০ দিনে একটি উপবাসব্রত পালিত হয়।


গুজরাট ও দাক্ষিন্যাত্যের জৈন ধর্মাবলম্বীরা আজও প্রতি বৎসর কয়েক সপ্তাহ ধরে উপবাস পালন করে থাকেন।


অন্যান্য ধর্মের উপবাসের মতো কঠোরতা সিয়ামের মধ্যে নেই। পবিত্র ইসলাম ধর্মে সিয়াম পালনে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা। মুসলমানদের সিয়াম সবচেয়ে সহজ, আনন্দদায়ক এবং বিজ্ঞানসম্মত।


মুসলমানরা উৎসবের মতই রোযা পালন করে থাকেন। অদুর ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞান রোযার আরো উপকারিতা আবিস্কার করবে ইন্শাআল্লাহ।


লেখকঃ অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান,তারাগঞ্জ কলেজ, কাপাসিয়া গাজীপুর।