চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে রোযা!

ইসলামিক শিক্ষা June 26, 2016 1,278
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে রোযা!

ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে নামাজের পরই মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা যে ইবাদত ফরজ করেছেন তা হলো রমজান মাসের সিয়াম বা রোযা। সিয়াম আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো বিরত থাকা।


ইসলামী পরিভাষায় সুবহে ছাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সংঘম থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বা রোযা বলে। রোযা আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি করে। রোযা মানুষে মানুষে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, হৃদ্যতা ও সৌজন্যবোধ আদান প্রদান করে। সাধারণভাবে আমরা মনে করে থাকি যে, রোযা ¯স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।


মাসব্যাপী রোযা পালনের ফলে শরীরের পুষ্টি ধারণে বিঘ্ন ঘটে । অসুস্থ রোগী আরো অসুস্থ্য হয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত গবেষণার ফলে বেরিয়ে আসছে রোযার চমৎকার উপকারিতার কথা। রোযা পালন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরতো নয়ই বরং রোযা রোগমুক্তির অন্যতম উপায়, সুস্থ্য হওয়ার গ্যারান্টি।


আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সুস্থ্য জীবন লাভের জন্য বেশি বেশি খাওয়ার প্রয়োজন নেই, বরং কম ও পরিমিত খাওয়াই সুস্থ্য জীবনের মূলমন্ত্র। গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে তা হলো- “বেশি বাঁচবি তো কম খাবি”- এই প্রবাদ বাক্যটি বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য প্রমাণিত।


প্রখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ইবনেসিনা তাঁর রোগিদের ৩ সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের নির্দেশ দিতেন। ঔষধের পরিবর্তে উপবাস রোগ মুক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। বৎসরে ১ মাস রোযা রাখার কারণে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিশ্রাম ঘটে।


মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিলে কারখানার মেশিন যেমন অনেকদিন টেকসই হয়, তেমনি রোযার ফলে মানবদেহের নানা যন্ত্রপাতির আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং রোগ-শোক কম হয়।


খেজুর গাছের রস মিষ্টির জন্যে গাছী কয়েকদিন বিরতি দিয়ে খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধে। উপবাস মানুষের জীবনে সুখ আনে, জীবনে আনে নতুন ছন্দ-গতি।


মুসলিম গবেষকগণ মনে করেন যে, মানুষের রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিষেধক আছে তার মধ্যে রোযা হলো সবচেয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসু প্রতিষেধক। মানুষের শরীরে সারা বৎসর জৈব বিষ জমা হয়। এই জৈব বিষ দেহের আয়ু এবং অন্যান্য জীব কোষকে খুবই দুর্বল করে দেয়।


এক মাসের রোযার ফলে এই জৈব বিষ দূর হয়ে যায়। রোযা দেহের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে। রোযা মানুষের হাইপারটেনশন কমাতে সাহায্য করে।


রাশিয়ার প্রখ্যাত শরীর বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাক্তার ডি,এন, নাকিটন বলেছেন-“তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থামিয়ে দিবে।


নিয়ম তিনটি হলো- অধিক পরিশ্রম করা, অধিক পরিমাণে ব্যায়াম করা এবং প্রত্যেক মাসে একদিন উপবাস থাকা।”


ডক্টর ডিউই জোড় দিয়ে বলেছেন-রোগাক্লিষ্ট মানুষের পাকস্থলি থেকে খাদ্য দ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, উপবাস থাকছে তার শরীরে বাসা বেঁধে থাকা দীর্ঘদিনের রোগটি।”


চিকিৎসা শাস্রের জনক ডাক্তার হিপ্পোক্রিট্যাস বহু শতাব্দি পূর্বে বলেছেন, “অসুস্থ্য দেহে যতই খাবার দিবে ততই রোগ বাড়তে থাকবে।”(চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযা)

একটানা ১মাস রোযা রাখার ফলে জিহ্বা ও লালা গ্রন্থি সমূহ বিশ্রাম পাওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলে এগুলো আরো সতেজ হয়। এতে জিহ্বায় খাদ্য দ্রব্যের ¯স্বাদ বৃদ্ধি পায়।


১ মাস সিয়াম পালনের ফলে বহুমুত্র রোগ কমাতে সাহায্য করে, অত্যধিক মোটা থেকে শরীরকে বাঁচায়, লালা গ্রন্থি সমূহ বড় হবার আশংকা থেকে মুক্তি পায়।


সারা বছর অতি ভোজনের ফলে অনেক মানুষেরই পাকস্থলী বড় হয়ে যায়। রোযা পালনের ফলে এই বড় পাকস্থলী ¯স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। রোযার মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্র জীবানু মুক্ত থাকে। পাকস্থলীকে বিশ্রাম দেয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে রোযা রাখা।


মানুষের পাকস্থলী রোযার সাহায্যে যে প্রভাবগুলো অর্জন করে তা খুবই উপকারী। এ পদ্ধতিতে পাকস্থলী থেকে নির্গত আর্দ্র পদার্থ সমূহ উত্তমভাবে তার ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়, যার কারণে রোযা পালনকালীন সময় গ্যাস জমা হতে পারে না।


যদিও সাধারণ ক্ষুধায় তা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু রোযার নিয়ত ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাস সৃষ্টি থেমে যায়। এর দ্বারা পাকস্থলী আঠাযুক্ত পদার্থ ও আর্দ্রতা তৈরীকারী কোষগুলো রমজানে বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ পায়। রোযা অন্ত্রগুলোকে প্রশান্তি দেয় এবং তাতে শক্তি সঞ্চার করে।


এতে সুস্থ্য র্আদ্র প্রদার্থ সৃষ্টি ও পাকস্থলীর আঠাযুক্ত পদার্থের নড়াচড়া হয়ে থাকে। এভাবে আমরা রোযার দ্বারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির আক্রমন থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি, যা হযমকারী নালের উপর হয়ে থাকে।(সুন্নতে রাসুল (সা) ও আধুনিক বিজ্ঞান)।


মুসলিম গবেষকগণ বলেন, পেপটিক আলসার রোযার কারণে তাড়াতাড়ি ভালো হয়। রোযার কারণে পাকস্থলী খাদ্যমুক্ত থাকে। এ সুযোগে পাকস্থলীর ক্ষতস্থান বা আলসার নিরাময়ে লেগে যায়। পাকস্থলী খালী হওয়া মাত্রই তার ক্ষয় পূরণ এবং পুনঃগঠনের কাজ শুরু হয়।


এভাবে দীর্ঘ এক মাসের রোযা মানুষের পেপটিক আলসার রোগ নিরাময় করতে সাহায্য করে। অনিয়মিত খাবার, অত্যধিক চা পান, ধুমপান, দুঃশ্চিন্তা ও টেনশন পেপটিক আলসার সৃষ্টি করে।


মুসলিম গবেষকগণের অভিমত, নিয়মিত রোযা পালনে বৈজ্ঞানিক কারণেই পেপটিক আলসার থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত পেট খালি রাখলে এবং নিয়মিত আহার করলে পেটে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যাতে আলসার বা ক্ষত শুকাতে সহায়ক হয়।


ডাক্তার ক্লীভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষনা মুলক পুস্তকে লিখেছেন, ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম। কেননা তারা সিয়াম পালন করে থাকেন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন- “সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না”।


১৯৫৮-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ডাক্তার মুহাম্মদ গোলাম মুয়ায্যম সহ কয়েক জন ডাক্তার ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে রোযার বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ গবেষনা করেছেন।


এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, পাকস্থলীর অম্ল রসের উপর প্রভাব শতকরা প্রায় ৮০ জন রোযাদারের বেলায় গ্যাস্ট্রিক এসিড স্বাভাবিক পাওয়া গেছে। শতকরা প্রায় ৩৬ জনের অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক হয়েছে। প্রায় শতকরা ১২ জন রোযা পালনকারীর এসিড একটু বেড়েছে, তবে কারো ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং রোযায় পেপটিক আলসার হতে পারে এমন ধারণা ভুল ও মিথ্যা।(স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ইসলাম)


একমাস রোযা রাখার সময় দৈনিক গড়ে প্রায় ১৪ ঘন্টা লিভার, অগ্নাশয়, প্লিহা, কিডনী ও মূত্রথলি একমাস পূর্ন বিশ্রাম পায়। এতে অঙ্গগুলোর বেশ উপকার হয়। রোযার ফলে কিডনী ও মুত্রথলির নানা প্রকার উপসর্গ ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে। অনেক মানুষ অস্বাভাবিক মোটা।


একমাস সিয়াম সাধনা এ ধরনের মোটা হওয়া থেকে রক্ষা করে। পুরো একমাস রোযা রাখার ফলে দেহে বাড়তি মেদ বা চর্বি হতে দেয়না। ফলে রক্তে কলেষ্টেরলের পরিমাণও স্বাভাবিক থাকে। মোটা লোকদের শরীরে বেশী মেদ বা চর্বি থাকাতে রক্তে কলেষ্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।


এর ফলে হৃদপিন্ড ধ্বমনী ও অন্যান্য অংগে রোগ দেখা দিতে পারে। ষ্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বর্তমানে পশ্চিমা দেশে দেহের ওজন কমানোর জন্য ১০ দিন কেবল চা, কফি, পানি ও বিস্কুট ছাড়া অন্য কিছু খেতে দেওয়া হয় না। তাদের সহজ উপায়ে ওজন কমানোর জন্য রোযা নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে।


মাঝে মাঝে নফল রোযার মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস করা যেতে পারে বলে মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ মনে করেন। রোযা পালন করলে শরীরের ওজন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। রোযায় শরীরের ওজন কমে যাওয়াতে কোন ক্ষতি হয়না। এভাবে শরীরের ওজন কমে যাওয়া খুবই উপকারী। শরীরের অধিক ওজন কমানোর জন্য রোযা এক প্রকার থেরাপিউটিক ব্যবস্থা।


প্রফেসর ডাক্তার মোহাম্মদ গোলাম মোয়ায্যম সহ কয়েকজন ডাক্তার ৬ বৎসর (১৯৫৮-১৯৬৩)ব্যাপী গবেষণা করে দেখিয়েছে যে, রোযা পালনের ফলে শতকরা প্রায় ৮০জন রোযাদারের শরীরের ওজন কিছু কমেছে। এই ওজন হ্রাসের পরিমাণ ১ মাসে এক থেকে দশ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে।


কিন্তু কোন রোযাদার এতে দুর্বলতার অভিযোগ করেননি বরং বেশি ওজনের লোকদের অনেকে ওজন হ্রাসের কারণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।(স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ইসলাম)


সিয়াম দেহের অন্ডকোষ এবং গ্রন্থিসমূহের নবজীবনীশক্তি প্রবাহিত করে দেয়। সিয়ামের মাধ্যমে জৈবিক চাহিদাকে সাময়িকভাবে নিস্তেজ করে মনকে পবিত্র ও ভাল কাজের দিকে মনোনিবেশ করা যায়। রোযা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে। এতে ধ্যান-ধারণা পরিস্কার ও সহজ হয়।


বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার আলেক্স হেইগ বলেছেন-“সিয়াম হতে মানুষের মানুষিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়, স্মরণ শক্তি বাড়ে, মনোযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবনশক্তি বেড়ে যায়।


ইহা খাদ্যে অরুচি ও অনিহা দূর করে। সিয়াম শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরকেও সিয়াম পালন করা উচিত”।(চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযা)


চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযা পালন যে ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী তা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে যত গবেষণা হবে ততই রোযার উপকারী দিকগুলো সুস্পষ্ট ভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠবে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আল্লাহর এই নেয়ামতকে খুশি মনে করেই পালন করবে। আল্লাহর এ ফরয এবাদত মানুষের রোগ মুক্তি, আধ্যাত্বিক উন্নতি ও সুস্থ্যতার গ্যারান্টি হিসেবে ভূমিকা রাখবে ইন্শাআল্লাহ্।


লেখকঃ অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান,তারাগঞ্জ কলেজ, কাপাসিয়া গাজীপুর।