মহানবী সা:-এর জীবন ও বদর যুদ্ধ

ইসলামিক ঘটনা June 22, 2016 6,011
মহানবী সা:-এর জীবন ও বদর যুদ্ধ

সুচনালগ্ন থেকেই মক্কার কাফেরেরা রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। সে সময় মক্কার কাফের মুশরিকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর মনোনীত দীন ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় ও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এমনকি পৌত্তলিকরা দারুণ নাদওয়াতে রাসূলে কারীম সা:কে হত্যা করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। ওকবা বিন আবু মুয়ীত রাসূল সা:-এর গলায় চাদর পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আবু জাহল ভারী পাথর দিয়ে তাঁর মস্তক চূর্ণ করতে চেয়েছিল। ইসলাম গ্রহণ করার আগে খাত্তাবের ছেলে উমর নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে তাঁকে হত্যা করতে গিয়েছিল। তারা রাসূল সা: ও মুসলমানের ওপর অমানুষিক নির্যাতন, সামাজিক বয়কট ও অর্থনৈতকি অবরোধ চাপিয়ে দিলো। এতে বানু হাশেম ও বানু মুক্তালিবের সব মুসলিম অমুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুসহ আল্লাহর রাসূল সা: আবু তালেবের ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল।


তিনটি বছর সর্বাত্মক সামাজিক বয়কট, অর্থনৈতিক অবরোধ, রাসূল সা.-এর পরম শুভাকাক্সক্ষী ও হিতাকাক্সক্ষী আবু তালেবের মৃত্যু, ইসলামী আন্দোলনের জন্য সর্বস্ব উৎসর্গকারিণী নিবেদিতাপ্রাণ হজরত খাদিজা রা:-এর ইনতিকাল এবং তায়েফের ময়দানে অমানুষিক নির্যাতনে মহানবী সা: মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এমনি এক কঠিন মুহূর্তে তিনি মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন।

মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম ছয় মাস মহানবী সা: নির্বিঘ্নে সময় কাটান এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর পরই কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। মদিনার খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মদিনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরাও মদিনা সনদের শর্ত ভঙ্গ করে কুরাইশদের মদিনা আক্রমণে প্ররোচিত করে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যের অজুহাতে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য সিরিয়া গমন করে। সে কাফেলায় অনেক সম্পদ ছিল। এক হাজার উটের পিঠে পঞ্চাশ হাজার দীনারের পণ্যসমাগ্রী ছিল। পঞ্চাশ হাজার দিনার হচ্ছে ২৬২ কিলোগ্রাম সোনার সমান। এ সফরের লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করা। ফেরার পথে মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে মর্মে মক্কায় গুজব ছড়িয়ে পড়লে কুরাইশগণ আবু জাহেলের নেতৃত্বে ১৩০০ সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণের জন্য বদর অভিমুখে রওনা হয়। সে হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর কসম, আমরা বদরপ্রান্তরে গিয়ে তিন দিন অবস্থান না করা পর্যন্ত মক্কায় ফিরে যাবো না। এ সময় আমরা সেখানে উট জবাই করব, আনন্দ-ফুর্তি করব, মদের আসর জমাব, দাসীরা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য গান গাইবে। কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল।


বদর যুদ্ধ ছিল মূলত একটি অসমযুদ্ধ।

মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩, কারো মতো ৩১৪ এবং কারো মতে ৩১৭ জন। সমস্ত সৈন্যদলে ঘোড়া ছিল মাত্র দুটো। উট ছিল সত্তরটি। দু’তিনজন পালাক্রমে একটি উটের ওপর আরোহণ করিছেলেন। অপর দিকে, শত্রুবাহিনীর সৈন্য এক হাজার। ঘোড়া একশত, বর্ম ছিল ছয় শত। উটের সংখ্যা অনেক। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিল আবু জাহেল।

৬২৪ ঈসায়ি সালের ১৭ মার্চ ও ১৭ রমজান মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর প্রান্তরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১৪ জন সাহাবা শাহাদত বরণ করেন। শত্রুপক্ষের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়। বন্দীদের মধ্যে রাসূল সা:-এর পিতৃব্য হজরত আব্বাস রা: এবং আবু তালেবের দুই পুত্র তালেব ও আকিলও ছিলেন। তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। শত্রুবাহিনীর অধিনায়ক আবু জাহেল, উমাইয়া, উতবা, থাইবা, ওলিদ চব্বিশজন কুরাইশ নেতা নিহত হয়। মহানবী সা:-এর নির্দেশে বদরের দিন কুরাইশদের চব্বিশজন বড় বড় নেতার লাশ বদরের একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়। নিহত কুরাইশ নেতাদের সম্বোধন করে বলেন, হে অমুকের পুত্র অমুক। হে অমুকের পুত্র অমুক। তোমরা যদি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে তাহলে সেটা কি তোমাদের জন্য মঙ্গল হতো না? আর মহান আল্লাহ আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন আমরা তার সত্যতার যথার্থ প্রমাণ পেয়েছি। তোমরা কি তোমাদের প্রভুর কৃত ওয়াদার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছ?

বদর যুদ্ধে সরাসরি ফেরেশতারা অংশগ্রহণ করেছিল। এদের নেতৃত্বে ছিলেন হজরত জিবরাঈল আ: ও মিকাইল আ:। মূলত তাঁদের দায়িত্ব ছিল দুটো। প্রথমত, মুসলমানদের সাহস বৃদ্ধি করা এবং তাদের মনোবল অটুট রাখা। দ্বিতীয়ত, বিজয়ের সংবাদ শোনানো। প্রথমত, মহান আল্লাহ এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্যের ওয়াদা দেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ ও প্রার্থনা করছিলে তিনি তোমাদের প্রার্থনা এ বলে মঞ্জুর করলেন যে আমি তোমাদের এক হাজার ধারাবাহিকভাবে আগত ফেরেশতা দিয়া সাহায্য করব’ (আনফাল-৯)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, একজন আনসারী সাহাবি বদর রণাঙ্গনে একজন মুশরিককে ধাওয়া করছিলেন। হঠাৎ সে মুশরিকের ওপর চাবুকের আঘাতের শব্দ শোনা যাচ্ছিল আর কে যেন বলছিল যাও, সামনে এগিয়ে যাও। সাহাবি লক্ষ করলেন, মুশরিক ব্যক্তি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার নাকে চোখে আঘাতের চিহ্ন। রক্তাক্ত চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল, তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অথচ আঘাতকারীকে দেখা যাচ্ছিল না। সেই আনসার সাহাবি রাসূল সা:কে এ ঘটনার বর্ণনা দিলে মহানবী সা: বললেন, তুমি সত্যই বলেছ। এটা ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য (মুসলিম দ্বিতীয় খণ্ড)।


বদরযুদ্ধে একজন আনসার সাহাবি হজরত আব্বাস রা:কে গ্রেফতার করে নিয়ে এলেন। হজরত আব্বাস রা: তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, আমাকে তো এ লোকটি বন্দী করে নিয়ে আসেনি। আমাকে মুণ্ডিত মস্তকের একজন লোক গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। সুদর্শন লোকটি একটি চিত্রল ঘোড়ার পিঠে আসীন ছিল। এখন তো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আনসার সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমিই তো তাকে বন্দী করে নিয়ে এসেছি। রাসূল সা: বললেন, চুপ করো, মহান আল্লাহ একজন সম্মানিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করেছেন (আর রাহিকুল মাখতুম, ২৫৫ পৃ.)।

বদরি সাহাবিদের মর্যাদা এত বেশি যে, মহান আল্লাহ তাদের শানে বলেছেনÑ তোমাদের যা ইচ্ছে তাই আমল করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। অনুরূপ বদরি ফেরেশতাদেরও মর্যাদা রয়েছে। হজরত জিবরাঈল আ. নবী করীম সা.-কে প্রশ্ন করলেন, বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে আপনি কি অভিমত পোষণ করেন? জবাবে তিনি বললেন, আমি বদরি সাহাবিদের মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম মনে করি। জিবরাঈল আ: বললেন, ফেরেশতাদের মধ্যে যারা বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারাও অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী (বুখারি)।

অভিশপ্ত শয়তান ছোরাকা ইবনে মালেকের আকৃতি ধারণ করে বদর প্রান্তে এসেছিল। সে যখন দেখতে পেলো হজরত জিবরাঈল আ:-এর নেতৃত্বে ফেরেশতারা প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করল তখন শয়তান ছুটে পালাতে লাগল। কিন্তু হারেস বিন হিশাম রা: তাকে ছোরাকা ইবনে মালেক মনে করে ধরে ফেললেন। কিন্তু ইবলিস হজরত হারেসের বুকে প্রচণ্ড ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল। মুশরিকরা বলতে লাগল ছোরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বল নাই যে, আমাদের সাহায্য করবে? আমাদের ছেড়ে পালাবে না? ছোরাকার ছদ্মরূপী শয়তান বলল- ‘আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। আমি আল্লাহকে ভয় করছি। তিনি কঠোর শাস্তিদাতা’ (আনফাল-৪৮)।


বদর যুদ্ধে রাসূল সা: এ বলে দোয়া করছিলেন, হে আল্লাহ! তুমি তোমার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করো। হে মহান আল্লাহ, তুমি কি এটা চাও আজকের পরে কখনো তোমার ইবাদত করা না হউক? একপর্যায়ে হজরত আবু বকর রা: তাঁর হাত ধরে বললেন, ওহে আল্লাহর রাসূল! এতটুকু দোয়াই তো আপনার জন্য যথেষ্ট। এরপর তিনি কুটির হতে বের হলেন এবং বলতে লাগলেন এই দল তো শিগগিরই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে যায়।হজরত জিবরাঈল আ:-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের এক বিশাল বহর এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ, আবু জেহেলসহ কুরাইশ নেতাদের নিহত হওয়া এবং এই অভিযানে পিতা-পুত্রের ও ভাই-ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়া মহান আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।

বদর যুদ্ধের বিজয় মূলত নৈতিকতা ও আদর্শের বিজয়। ধৈর্যশীল ও নৈতিক মানসম্পন্ন একটি ক্ষুদ্র দলও একটি বিরাট দলের ওপর বিজয়ী হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, বদরের যুদ্ধে মহান আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল ও নগণ্য (আলে ইমরান-১২৩)।

বদরি সাহাবি আল্লাহর সাহায্যের উপযোগী হওয়ার জন্য শর্ত পূরণ করেছিল দুটো। একটি হচ্ছে ধৈর্য, দ্বিতীয়টি হলো তাকওয়া। বদরের বিজয়কে মহান আল্লাহ ‘ইয়াউমুল ফুরকান’ অর্থাৎ, হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেদিন বদর যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের পক্ষে না এলে হয়তো ইসলামের ইতিহাস ভিন্নভাবে মোড় নিতো। বাহ্যত এটি একটি স্থানীয় যুদ্ধ মনে হলেও বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এর ফলে একটি সুমহান বিপ্লব সাধিত হয়।

অধ্যাপক হিট্টি বলেন, এটি ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম প্রকাশ্য বিজয়। R.A Nichalson বলেন, The Battle of Badar is not only the most celebrated Battle in the memory of muslims it was really also of a great historical importance.

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা, অ্যান্টি ইসলাম ও খোদাদ্রোহী শক্তির চরম পরীক্ষা এবং মুসলমানদের নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয়।

হিট্টির ভাষায় - ‘যত নগণ্যই হোক বদর যুদ্ধ মুহাম্মদ সা:-এর পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।’ বদর যুদ্ধের ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বদর যুদ্ধের বিজয় মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামি আন্দোলনের কর্মী ও লড়াকু সৈনিকদের জন্য এক প্রেরণার উৎস। এটি কেয়ামত পর্যন্ত উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে।

ঐতিহাসিক নিকলসনের ভাষায়, ‘ম্যারাথন সংগ্রামের মতো বদর যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বৃহত্তম স্মরণীয় সংগ্রাম। এটি সর্বকালের জন্য আরব দেশে ইসলাম, এমনকি সমগ্র পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে।’


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও কোনো জনগোষ্ঠী আল কুরআনের শর্ত পূরণ করতে পারলে সফলতা বিজয় ও সম্মান তাদের পদচুম্বন করবে। ঈমানি শক্তি, ধৈর্য্য ও নৈতিকতা অর্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের আল কুরআনকে বিজয়ী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।