ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন 'খৈয়াছড়া' থেকে!

দেখা হয় নাই June 19, 2016 931
ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন 'খৈয়াছড়া' থেকে!

চট্টগ্রাম শহরের কাছেই পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা পরিবেশে চমৎকার 'খৈয়াছড়া' ঝর্ণার অবস্থান। এই ঈদের ছুটিতে কম সময়ে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পেতে হলে পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে রাখতেই পারেন এই ঝর্ণার নাম।


দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জানতই না এই ঝর্ণার কথা। দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে যেন লুকিয়ে ছিল এই অপূর্ব স্থানটি। ২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে কুণ্ডেরহাট ব্লকের ২৯৩৩.৬১ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করায় খৈয়াছড়া ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়।


খৈয়াছড়ার বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য ঝর্ণার মতো এটি সরাসরি ওপর থেকে নিচে এসে পড়েনি। ঝর্ণাটির মোট সাতটি (কারো মতে নয়টি) ধাপ আছে। এর মধ্যে নিচ থেকেই দেখা যায় তিনটি ধাপ, ওপরের চারটি ধাপ দেখতে হলে বাম পাশের প্রায় খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে আরো শ'খানেক ফুট ওপরে।


তবে ওপরের সৌন্দর্যের তুলনায় এটা কিছুই না। ওপরে উঠলে দেখা মিলবে আরো একটি ধাপের। এর বাম পাশ দিয়ে সামান্য হাঁটলেই দেখা মিলবে অপর তিনটি ধাপের।


এতেও যদি আপনার মন না ভরে তাহলে এই তিনটি ধাপের পাশ দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে যান আরো ওপরে, সেখানে আশপাশের বহুদূর বিস্তৃত পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনাকে ভুলিয়ে দেবে আপনার পরিশ্রম আর নিরাপদে নিচে ফিরে যাওয়ার ভাবনার কথা।


বাংলাদেশে এমন ঝর্ণা আর দ্বিতীয়টি নেই। তবে এ তো পরের কথা। ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তাটিও কম মনোমুগ্ধকর নয়। বড় তাকিয়া বাজার ছাড়িয়ে যখন হাঁটা শুরু করবেন, শুরুতে রাস্তা সমতলই থাকবে। অদূরে চোখে পড়বে জঙ্গলে ঢাকা বিশাল সব পাহাড়।


যা হোক, খানিকক্ষণ হাঁটলেই রাস্তা উঁচু-নিচু হতে থাকবে। এভাবে একসময় এসে পড়বেন পাহাড়ি ঝিরিপথে।


এরপরই শুরু হবে আপনার আসল অ্যাডভেঞ্চার। এখানে কোনো রাস্তা নেই, ঝিরি ধরেই আপনাকে হাঁটতে হবে।


কখনো হাঁটুপানিতে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটবেন তো সেই পানিই কখনো কখনো আপনার কোমর ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে আসবে।


মাঝেমধ্যে ঝিরি ছেড়ে পাশের টিলায় উঠে পড়তে পারবেন। চারপাশের জঙ্গল দেখে মনে হবে মানববসতি ছেড়ে কোনো দুর্গম জায়গাতেই না এসে পড়েছেন। এভাবেই হাঁটতে হবে দেড় ঘণ্টার মতো। আপনার চলার গতির ওপর নির্ভর করবে কতক্ষণে পৌঁছাবেন গন্তব্যে। পথেই বেশ কয়েকবার দেখবেন পানি ঝর্ণার মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তবে এতে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই, আসল চমক সামনে অপেক্ষা করছে।


ঝর্ণার কাছে পৌঁছানোর আগেই ঝমঝম শব্দে পানি পড়ার শব্দে বুঝে যাবেন আপনার গন্তব্যের কাছে চলে এসেছেন। তারপর যখন গাছপালার আড়াল থেকে খৈয়াছড়ার দর্শন পাবেন, তখন বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।


অনেক উঁচু থেকে প্রবল শব্দে নিচের পাথরের ওপর আছড়ে পড়া পানি দেখা গোসলের লোভ সামলানো বেশ শক্ত হয়ে পড়বে। নেমে পড়ুন বরফশীতল ঠান্ডা জলে। ডুবে যাওয়ার ভয় নেই, পানি কখনই আপনার বুক ছাড়াবে না, কাজেই সাঁতার না জানলেও সমস্যা নেই। তবে সাবধান থাকা ভালো। ঝর্ণার ডানদিক অপেক্ষাকৃত গভীর।


আর আপনি যদি পাখিপ্রেমী হন, অর্থাৎ ঝর্ণা দেখা ছাড়াও বন্য পরিবেশের প্রতি যদি আপনার আগ্রহ থাকে, তাহলে এই ঝর্ণা আপনাকে নিরাশ করবে না। ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তায় দুই পাশের রাস্তায় দেখা মিলবে ঘুঘু, টিয়া, কাঠঠোকরাসহ হরেক রকম পাখপাখালির। তবে এরই মধ্যে অপরিণামদর্শী মানুষ পথের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল পরিষ্কার করে সেখানে লাগিয়েছে নানা অর্থকরী গাছ, যা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ করেছে এখানকার সৌন্দর্য।


যেভাবে যাবেন

ঢাকার যেকোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠে পড়লেই হবে। ভাড়া পড়বে ৪৮০ টাকা। পথে যানজট না থাকলে সাত ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সেখান থেকে গাড়ি, সিএনজি অথবা বাসে করে যেতে হবে মিরসরাই উপজেলার বড় তাকিয়া বাজারে।


এক্ষেত্রে সময় আর ভাড়া বিবেচনা করলে বাসই সবচেয়ে পছন্দের বাহন হওয়া উচিত। বাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। বেশি লোক থাকলে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন অথবা যেতে পারেন সিএনজিতে। সেক্ষেত্রে ভাড়া দরদাম করে ঠিক করতে হবে।


বড় তাকিয়া বাজারে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের কাছে গিয়ে স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই তারা বলে দেবে কোন পথে যেতে হবে। চাইলে গাইডও নিতে পারেন, তবে নিজেরা গেলেই রোমাঞ্চের স্বাদ বেশি পাওয়া যাবে। ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তা একটিই, আর পথে আরো অনেক অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসীর দেখা পাবেন, কাজেই পথ হারানোর ভয় নেই বললেই চলে।


জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথ ধরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটলে দেখা পাবেন ঝর্ণার। হাতে সময় নিয়ে যাওয়া ভালো, ঝর্ণা দেখে ফিরতে ফিরতে বেশ সময় লাগবে। খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন, তবে ঝর্ণায় যাওয়ার পথেই অন্তত তিনটি জায়গায় দেখা মিলবে স্থানীয় হোটেলের, চাইলে সেখান থেকেও খেয়ে নিতে পারেন। খাবারের দাম তুলনামূলক সস্তাই হবে।


মনে রাখবেন

চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। এই ঝরনা বাংলাদেশের মানুষের সম্পদ। অপচনশীল এসব আবর্জনা ফেলে এর পরিবেশ নষ্ট করা আপনার কোনোভাবেই উচিত হবে না। আবর্জনা ফেলার জন্য পথেই ডাস্টবিন পাবেন, না পেলে কষ্ট করে নিজের সঙ্গে রাখুন, বাইরে এসে কোথাও ফেলবেন।


পথে জোঁক থাকতে পারে, সতর্ক থাকবেন। লবণ সঙ্গে রাখলে ভালো হয়। জোঁক কামড়ালে হাত দিয়ে টেনে ছাড়াতে যাবেন না, লবণ ছিটিয়ে দিলেই কাজ হবে। সিগারেটের তামাকও ব্যবহার করতে পারেন।


ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম। শিশু, বয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না, নিজেও যথেষ্ট সতর্ক থাকবেন। মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওই দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব।


মোট সাত ধাপের এই ঝর্ণার পাশের খাড়া পাহাড় দিয়ে একদম ওপরে ওঠা যায়। তবে এই পথ অত্যন্ত দুর্গম আর বিপজ্জনক। পা ফসকে নিচে পড়লে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।


কাজেই পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে ওপরে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো।