অপরাধ দমনে রমজানের ভূমিকা

ইসলামিক শিক্ষা June 10, 2016 1,188
অপরাধ দমনে রমজানের ভূমিকা

বছর ঘুরে আবারও আমাদের কাছে এলো পবিত্র রমজান। রমজানের মূল ইবাদত হলো সিয়াম তথা রোজা। আর রোজার লক্ষ্য হলো মানুষকে মুত্তাকি (খোদাভিরু) বানানো। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে সিয়াম, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগের লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)


তাকওয়া কী? তাকওয়া অর্থ আল্লাহভীতি। তাফসিরে এসেছে—‘আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বেঁচে থাকাই তাকওয়া।’ (তাফসিরে জালালাইন : ১/৯) ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে, তাকওয়া তো মানুষের মনে আল্লাহর ভয়ে হালাল-হারামের বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভীতি, যা মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রত্যেক মানুষের গোপনে অপরাধ করার প্রবণতা থাকে। যেখানে পুলিশ কিংবা কোনো মানুষ পাহারা দিতে পারে না। সেই গোপন অপরাধের জায়গায় আল্লাহর ভয়ের অদৃশ্য পাহারাটাই হলো তাকওয়া। রোজার মাধ্যমে এই পাহারা মজবুত হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বমানবতার জন্য যে সংবিধান (কোরআন) নাজিল করেছেন, তাকওয়ার আদেশের মাধ্যমে তার প্রতি অনুগত করতে চেয়েছেন। কারণ জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে কোনো আইনকেই প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।


বর্তমানে সমাজ থেকে অপরাধ দমনে দুটি ব্যবস্থা বিদ্যমান।


১. আইন (Law),


২. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (Law enforcing agency)।


পৃথিবীর বাস্তবতা বলছে, আইনের প্রতি জনগণ শ্রদ্ধাশীল না হলে শুধু আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে সমাজ থেকে অপরাধ দমন করা যায় না। একের পর এক আইন প্রণয়ন করা হলেও তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। বরং তা হয় এর বিপরীত। পুলিশের আইডি কার্ড হয়ে যায় অপরাধের অঘোষিত লাইসেন্স। আমাদের দেশের বাস্তবতাও এর ভিন্ন নয়। রাজধানীর শাহ আলীর গুদারাঘাটের চা দোকানি বাবুল মাতুব্বরের কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে তার ওপর চুলা ফেলে দেয় পুলিশ। দগ্ধ হয়ে মারা যান হতভাগা চা দোকানি। (কালের কণ্ঠ : ০৫-০২-২০১৬)


বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় খোদ র্যাবের তদন্ত রিপোর্টেই অধিনায়ক সাঈদসহ ২৪ জন র্যাব সদস্য সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। (কালের কণ্ঠ : ২৮-১১-২০১৪)


বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলেছে, এক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন ৪৪ জন নারী। তাঁদের ৪০ জনই নির্যাতিত হয়েছেন পুলিশের দ্বারা। (প্রথম আলো : ১৬-০৫-২০১৫) ২০১৫ সালে সিকিউরিটি সেলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় আট হাজার। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগই হত্যা, ধর্ষণ কিংবা মাদক চোরাচালানের মতো গুরুতর। (যুগান্তর : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬)


টিআইবির একাধিকবারের প্রতিবেদনে অপরাধে শীর্ষে পুলিশ। পুলিশকে মনিটরিং করার জন্য রয়েছে সংস্থা, আবার সেই সংস্থাকেও মনিটরিং করা হচ্ছে; কিন্তু এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।


সাধারণ মানুষের আশ্রয় পুলিশ। অপরাধ দমনই পুলিশের কাজ। সেই পুলিশই যদি হয় অপরাধের গডফাদার, তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার জায়গা কোথায়? এর মূল কারণ হলো, পুলিশ-নাগরিক কেউই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। আইনকে ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা যেমন সাধারণ জনগণের মধ্যে রয়েছে, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও আইন লঙ্ঘন করেন।


পক্ষান্তরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই পৃথিবীকে অপরাধ থেকে মুক্ত করার জন্য যে ঐশী ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন, তার ধাপ হচ্ছে ৩টি।


১. আইন বা Law (কোরআন-সুন্নাহ),


২. তাকওয়া বা God fearing (খোদাভীতির মাধ্যমে আইনের প্রতি মানুষকে অনুগত করে তোলা),


৩. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (Law enforcing agency)।


ইতিহাস সাক্ষী, এই ব্যবস্থাপত্র শতভাগ সফল হয়েছিল। কারণ এতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আইন প্রণয়নের পরই মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়া আইন বাস্তবায়নে শতভাগ সফল হয়েছিল।


সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াত নাজিল করে যখন মদ নিষিদ্ধ করা হলো, তখন রাসুলে আকরাম (সা.) হাফেজ সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন গলিতে গলিতে আয়াতটি পাঠ করার জন্য। আইন প্রণেতার ভয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধার ফলে তখন কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক ছাড়াই সাহাবায়ে কেরাম মদ ত্যাগ করলেন। মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা শুনে যাঁর হাতে মদের গ্লাস ছিল তিনি তা ছুড়ে ফেললেন, যাঁর মুখে মদ ছিল তিনি তা ফেলে দিয়ে কুলি করলেন, যিনি ওই সময় মদ পানরত ছিলেন, তিনি গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পেট থেকে মদ বের করার চেষ্টা করলেন। যাঁর বাড়িতে মদের কলসি ছিল, তিনি লাথি মেরে তা ভেঙে ফেললেন। মদিনার রাস্তায় মদ প্রবাহিত হয়ে গেল। (ইবনে কাসির : ৭/৯০৯)


পুলিশ-জনগণ সবাইকে আল্লাহর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য যে বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা-ই রমজান। একটি দেশের ক্ষুদ্রতম ইউনিট (একক) হচ্ছে নাগরিক, প্রত্যেক নাগরিক যতক্ষণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হবে, ততক্ষণ সে আইন সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আইন মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরির জন্য, অপরাধপ্রবণতা থেকে বাঁচানোর জন্যই রোজার ব্যবস্থা।


সিয়াম তথা রোজার সংজ্ঞার দিকে তাকালেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ রোজার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘পানাহার, সহবাস ও সব ধরনের গুনাহর কাজ ছেড়ে দেওয়াই রোজা।’ শুধু পানাহার ত্যাগ করে গুনাহর কাজ না ছাড়লে তা রোজা হবে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়; সিয়াম হলো অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ বর্জন করা। (বায়হাকি : ৪/২৭০) অর্থাৎ রোজার মাধ্যমে পবিত্র কোরআনে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো ছেড়ে দেওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। নিজেকে বিরত রাখতে হবে সব ধরনের মিথ্যা ও পাপাচার থেকে। কোরআনের শান্তির সমাজ গড়ার মিশন বাস্তবায়নের মতো যোগ্য ও তাকওয়াসম্পন্ন (মুত্তাকি) নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করতে না পারবে, তার পানাহার ত্যাগ করা আল্লাহ তাআলার কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি : ৫/২২৫১)


সিয়াম কোরআনের আইনের প্রতি মানুষের মনে ভীতি ও শ্রদ্ধা তৈরি করবে সযত্নে। রোজা পানাহার নিয়ন্ত্রণ করে আর অপরাধ প্রবণতাকে করে সমূলে উৎপাটন। রমজান শেষে পানাহার চালু হবে বটে; কিন্তু অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার যে বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়েছিল তা চলবে সারা বছর।

রোজা অপরাধের হাত-পা মজবুতভাবে বেঁধে দেবে তাকওয়ার রশি দিয়ে। আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) থাকলে রাতের অন্ধকারেও অন্যায় থেকে বিরত থাকা সম্ভব। মানুষের অন্তরে তাকওয়াবিধৌত সেই অদৃশ্য পাহারাই বসাবে রোজা। তাকওয়ার মাধ্যমে অপরাধ দমন হবে সমাজ থেকে। মানুষ বাঁচবে মানুষের অনিষ্ট থেকে। কেউ কারো ক্ষতি করবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তির সমাজ।